প্রতিটি মানুষই স্বতন্ত্র। তার নিজস্ব ব্যক্তিসত্তা রয়েছে, রয়েছে সতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। কেউ সহজে মানুষের সাথে মিশতে পারেন আবার কেউ অস্বস্তিতে ভোগেন। মানুষের সাথে সহজ স্বাচ্ছন্দ্য হতে পারেন না। পরিবারের বাইরে আমাদের আর একটি পরিবার হলো কর্মক্ষেত্র। সেখানে যেহেতু দিনের অনেকটা সময় পার করতে হয় তাই সেখানে নিজের একটি আলাদা ভাবমূর্তি গড়ে তোলা দরকার। কর্মক্ষেত্রে নিজের উপর আত্মবিশ্বাস রাখা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের।
কর্মক্ষেত্রে নিজের ইমেজ ডেভেলপমেন্ট এর জন্য কোন ব্যক্তিকে জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় কিছু বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হয়। নিজেকে আরও উন্নত করা, সুন্দরভাবে কথা বলা, দক্ষতার সঙ্গে সমস্যার সমাধান করা, মানুষের সঙ্গে মেশা, ভালো প্রেজেন্টেশন দেওয়া, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চলা, যোগাযোগ দক্ষতা ইত্যাদি বিষয়গুলোতে নজর দিতে হয়। নিজের ভাবমূর্তি উন্নয়নে নিজের সেরাটুকু দিতে হবে। চলাফেরা, কথাবার্তা, আচার-আচরণ—সবকিছু মানুষকে অনেক আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
কর্মক্ষেত্রে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলা ব্যক্তিগত ও পেশাগত সাফল্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইতিবাচক ভাবমূর্তি সহকর্মী ও ঊর্ধ্বতনদের মধ্যে আপনার প্রতি আস্থা তৈরি করে, যা ভবিষ্যতে আপনার কর্মজীবনে উন্নতির সম্ভাবনা বাড়ায়। কর্মক্ষেত্রে ভালো মনোভাব বজায় রাখা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি পেশাগত দক্ষতা ও আন্তরিকতাও অনেক ভূমিকা রাখে। নিচে কর্মক্ষেত্রে ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরির কিছু কার্যকর পরামর্শ দেওয়া হলো । যা যে কোনো কর্মজীবীর জন্য পেশাগত ক্ষেত্রে নিজস্ব ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। যোগাযোগ স্পষ্ট হলে কাজ দ্রুততায় শেষ করতে পারবেন।
পেশাগত দক্ষতা বাড়ান : পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর জন্য নিয়মিত জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করুন। নিজেকে আপডেটেড রাখুন এবং প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করুন। যেকোনো সমস্যা সমাধানে দক্ষতা দেখানোর চেষ্টা করুন, কারণ দক্ষ কর্মী সব সময়ই গুরুত্ব পায়। প্রয়োজনে সহকর্মীদের থেকে কাজ শেখার আগ্রহ প্রকাশ করুন।
নিশ্চিত হয়ে কাজ করা : নিজের কাজ ভালো করে বোঝার জন্য এবং ঠিক মতো শেষ করার জন্য বারবার যোগাযোগ করা এবং কাজ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে যার অধীনে চাকরি করছেন, সেই বসের কাছ থেকে কাজের পরিধি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে নিশ্চিত হয়ে নিন। প্রয়োজনে পুরো কাজ আবারও বুঝে নিতে হবে।
সময়নিষ্ঠ এবং দায়িত্বশীল হোন : সঠিক সময়ে কাজ শেষ করার অভ্যাস গড়ে তুলুন। প্রতিশ্রুতি পূরণে যত্নবান এবং দায়িত্বশীল হোন। এতে করে সহকর্মী এবং ঊর্ধ্বতনরা আপনাকে নির্ভরযোগ্য মনে করবেন, যা ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরিতে সহায়ক।
সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব রাখা : কর্মক্ষেত্রে দলগত কাজ করার সময় সহকর্মীদের প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব রাখুন। অন্যের সফলতায় আনন্দ প্রকাশ করুন এবং প্রয়োজন হলে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিন। এতে কাজের পরিবেশে ইতিবাচক আবহ তৈরি হয়। অন্যের সাহায্য ছাড়াই কাজ করার উদ্যম প্রকাশ করা। নিজের উদ্যোগে কাজের ধরন ও বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করুন।
পেশাদারি আচরণ বজায় রাখা : যে অফিসে চাকরি করছেন তার কিছু নিয়ম-নীতি রয়েছে সেগুলো অবশ্যই মেনে চলা জরুরি। কথাবার্তা, পোশাক-পরিচ্ছদ এবং আচরণে পেশাদারিত্ব বজায় রাখুন। শালিন ও মার্জিত পোষাক পড়বেন। অফিসে সবার সঙ্গে শালীন, নম্র এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখার চেষ্টা করুন। এই গুণগুলো আপনাকে কর্মক্ষেত্রে সম্মানিত করবে। কোনো কিছুর অপচয় করবেন না। তাড়াহুড়া করে বারবার ভুল করবেন না।
সহকর্মীদের সম্মান করতে হবে। সবাই ঊর্ধ্বতনদের সম্মান করে অভ্যস্ত কিন্তু সহকর্মীদের অনেকেই প্রাপ্য সম্মান দিতে চান না। তাদেরকে প্রতিযোগী ভাবেন। ব্যাপারটা মোটেও ঠিক না। সহকর্মী বয়সে যতই ছোট হোক, সকলকে সম্মান করা উচিৎ। সকলের সাথে মিলেমিশে চলুন।
ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করা : কোনো সমস্যা বা চাপের মধ্যে পড়লেও ইতিবাচক মনোভাব বজায় রাখুন। সব সময় সমস্যার সমাধানে মনোযোগ দিন এবং নেতিবাচক মন্তব্য এড়িয়ে চলুন। ইতিবাচক মনোভাব কাজের পরিবেশে অন্যদেরও অনুপ্রাণিত করতে সহায়ক।
সামাজিক কর্মকান্ডে অংশ নিন : অফিসে বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কর্মকান্ড হয়ে থাকে। সেগুলোতে অংশ নিন। কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে মাঝে মাঝে আড্ডা দিন, বাসায় দাওয়াত করুন।
নিজের যোগ্যতা ও সক্ষমতাকে বিবেচনায় রেখে কাজ করুন। দীর্ঘমেয়াদে যে কাজের চাপ আপনি নিতে পারবেন না, সে কাজে না জড়ানোই ভালো,
অবান্তর আশা-প্রত্যাশা চাহিদা আপনাকে কর্মক্ষেত্রে অসহনীয় করে তুলতে পারে। তাই বাস্তবসম্মত চিন্তা করুন।
অফিস রাজনীতি এড়িয়ে চলা : কর্মক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থাকা এবং অফিস রাজনীতিতে না জড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ। অফিসে বিভিন্ন মতামত থাকতে পারে, তবে সেই মতামতগুলোকে শ্রদ্ধা করুন এবং ব্যক্তিগত পক্ষপাত এড়িয়ে চলুন।
ফিডব্যাক গ্রহণ ও প্রয়োগ করা : উন্নতির জন্য সহকর্মী এবং ঊর্ধ্বতনদের কাছ থেকে পাওয়া ফিডব্যাক খোলা মনে গ্রহণ করতে হয় এবং প্রয়োজনে তা প্রয়োগ করুন। এই মানসিকতা আপনার ব্যক্তিত্বকে আরো ইতিবাচকভাবে তুলে ধরবে।
আত্মবিশ্বাসী ও উদ্যোগী হোন : যেকোনো কাজে আত্মবিশ্বাসী থাকা এবং নতুন প্রকল্পে অংশ নিতে আগ্রহ দেখানো ভালো। সঠিক উদ্যোগ দেখানোর মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে মানুষের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায় ও ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে।
মতামত প্রকাশ করা : আপনার কোনো মতামত প্রতিষ্ঠানের বেড়ে উঠা ও ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। তাই কর্মক্ষেত্রকে বোঝার চেষ্টা করুন, নিজের মনে করুন এবং পরিশিলীত ও বুদ্ধিদীপ্ত মতামত রাখার চেষ্টা করুন।
পরিস্থিতি বুঝে চলা : আপনার কোন কথা, কাজে সহকর্মীরা বিরক্ত হচ্ছে কিনা সেটা বোঝার চেষ্টা করুন ও বুঝে কর্মক্ষেত্রে চলুন। নিজেকে জাহির করার জন্য বেশি বেশি প্রশ্ন করতে যাবেন না।
অফিসের পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করার চেষ্টা করুন। নিজের টেবিল, কক্ষ, পরিবেশ পরিস্কার রাখুন। পরিচ্ছন্নতা ঈমানের অঙ্গ। আপনার কর্মের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখলে ভাবমূর্তি উন্নত হবে।
কর্মবান্ধব হওয়া: আপনার কথা ও কাজে যেন কেউ আঘাত না পায় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। পারলে মানুষকে সৎ পরামর্শ দিবেন। ছোট ছোট উপকার করার চেষ্টা করবেন। মনে রাখবেন সহকর্মীদের সাথেই আপনাকে কাটাতে হবে। এখান থেকেই আপনার রুটি রুজির ব্যবস্থা হচ্ছে। এটি পবিত্র স্থান। তার পবিত্রতা বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে।
রাগ নিয়ন্ত্রণ, সময় ব্যবস্থাপনা, নেতৃত্ব, কর্মক্ষেত্রে নীতিগত সততা, দলগতভাবে কাজ করার মানসিকতা, কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর সঙ্গে ব্যবহার, অনেক মানুষের মধ্যে কথা বলার ধরন ইত্যাদি। এছাড়া অফিসের সাধারণ ভদ্রতা, খাবার টেবিলের আচরণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মুঠোফোনে আসক্তি থেকে দূরে থাকার কৌশল, নীতিগত উন্নয়ন ইত্যাদি।
কর্মক্ষেত্রে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলা সময়সাপেক্ষ হলেও এটি দীর্ঘ মেয়াদে সফলতার পথ তৈরি করে। আপনার দক্ষতা, আচরণ এবং মনোভাবের সমন্বয়ে একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন, কর্মক্ষেত্রে ইতিবাচক ভাবমূর্তি শুধু কর্মজীবনের উন্নতি নয়, ব্যক্তিগত উন্নতিরও চাবিকাঠি।