পুদিনা পাতার গুণাগুণ ও ব্যবহার – ঘরোয়া চিকিৎসায় উপকারী ভেষজ

সুগন্ধিযুক্ত পুদিনা পাতার গুণাগুণ ঘরোয়া চিকিৎসায় উপকারী ভেষজ। এর পাতা রান্নায়, রূপচর্চায় এমনকি ঘরোয়া চিকিৎসায় প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। পুদিনা পাতা (Mentha spicata) রান্নায় স্বাদ বাড়ায়, ঘ্রাণ বাড়ায়। পুদিনা পাতায় রয়েছে অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। আজ আমরা জানবো পুদিনা পাতার গুণাগুণ, ব্যবহার এবং ঘরোয়া চিকিৎসায় এর ভূমিকা সম্পর্কে।

পুদিনা পাতার পুষ্টিগুণ

পুদিনা পাতা ভিটামিন এবং মিনারেলে সমৃদ্ধ। পুদিনা পাতায় রয়েছে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় ভিটামিন, মিনারেল ও ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস, যা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পুদিনা পাতার গুণাগুণ ঘরোয়া চিকিৎসায় এটি উপকারী ভেষজ। যারমধ্যে উল্লেখযোগ্য পুষ্টি উপাদানগুলো হলো:

ভিটামিন এ: চোখের স্বাস্থ্য ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।

পুদিনা পাতায় রয়েছে ভিটামিন সি যা ত্বক, হাড় ও সংযোগকারী টিস্যুর জন্য প্রয়োজনীয়।

এই পাতায় রয়েছে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স যা বিপাক উন্নতি, রোগ প্রতিরোধ বৃদ্ধি, চুল ত্বক ও স্নায়ুর উন্নতি ঘটায়।

ভিটামিন ই একটি শক্তিশালী এন্টিঅক্সিডেন্ট যা বার্ধক্য ও বলিরেখা দূর করে।

মিনারেলস: আয়রন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, জিংক ম্যাগনেসিয়াম ও পটাসিয়াম সমৃদ্ধ।

অ্যান্টি-অক্সিডেন্টস: ফ্রি র্যাডিকেলের বিরুদ্ধে লড়াই করে কোষের ক্ষতি রোধ করে। পুদিনা পাতায় এই ভিটামিন উপাদান রয়েছে।

মেন্থল: শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা ও পেশী ব্যথা কমাতে সহায়ক।

পুদিনা পাতার গুণাগুণ ও ঘরোয়া চিকিৎসায় উপকারী ভেষজ

পুদিনা পাতার গুণাগুণ অসংখ্য। এটি ঘরোয়া চিকিৎসায় ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়। বহু রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় এই পাতার ব্যবহারে। পুদিনা পাতার গুণাগুণ ও ঘরোয়া চিকিৎসায় কি কি রোগমুক্তি দেয় জেনে নিন।

১. হজমশক্তি বৃদ্ধি করে

পুদিনা পাতা পাচনতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত উপকারী। পেটের গ্যাস, বদহজম, বমিভাব, পেট ফাঁপা ও অ্যাসিডিটি কমায় পুদিনাপাতা। খাবারের পর এক কাপ পুদিনা পাতার রস বা চা পান করুন। পাচক রস নিঃসরণ বৃদ্ধি পাবে ফলে খাবার সহজে হজম হবে।

২. সর্দি-কাশি-শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা দূর করে

পুদিনাপাতার রস শ্বাসপ্রশ্বাসের নালি খুলে দেয়। এই পাতায় থাকা মেন্থল বা প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপ্টিক এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান শ্বাসনালীকে পরিষ্কার করে। কফ, সর্দি-কাশি ও অ্যাজমার সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। গরম পানিতে পুদিনা পাতা ফুটিয়ে ভাপ নিলে নাক বন্ধের সমস্যা দূর হয়।

৩. পুদিনা পাতার গুণাগুণ মাথাব্যথা ও মাইগ্রেন কমায়

পুদিনা পাতার তেল বা পেস্ট কপালে লাগালে মাথাব্যথা ও মাইগ্রেনের ব্যথা উপশম করতে পারে। কয়েকটি পুদিনা পাতা পিষে কপালে লাগালে বা এর রস শুঁকলে ব্যথা কমে যায়।

৪. মুখের দুর্গন্ধ দূর করে

অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল উপাদানে সমৃদ্ধ পুদিনা পাতা মুখের দুর্গন্ধ দূর করে। পুদিনা পাতা চিবালে বা পুদিনা পাতার রস দিয়ে কুলি করলে মুখের দুর্গন্ধ দূর হয়। মুখগহ্বরে থাকা জীবাণুমুক্ত করে পুদিনাপাতার রস।

৫. ত্বকের যত্নে পুদিনা পাতা

পুদিনা পাতার অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ ব্রণ, ফুসকুড়ি ও ত্বকের সংক্রমণ কমায়। পুদিনা পাতার পেস্ট মুখে লাগালে ত্বক পরিষ্কার সতেজ ও উজ্জ্বল হয়।

৬. ওজন কমাতে সাহায্য করে

পুদিনা হজম প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে। এটি খেলে খাবার দ্রুত হজম হয় এবং মেটাবলিজম বেড়ে যায়। পুদিনা পাতার চা ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে যা ওজন কমাতে ভূমিকা রাখে।

৭. মানসিক চাপ ও অনিদ্রা দূর করে

অনিদ্রা জনিত সমস্যা থেকে মুক্তি দেয় পুদিনা চা। পুদিনা পাতার সুগন্ধ স্নায়ু শান্ত করে উদ্বেগ ও মানসিক চাপ কমায়। ঘুমানোর আগে পুদিনা চা পান করলে ভালো ঘুম হয়।

৮. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে পুদিনা পাতায় থাকা পটাসিয়াম । এটি রক্তনালীগুলোকে শিথিল করে এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখে।

৯. মধুমেহ (ডায়াবেটিস) নিয়ন্ত্রণ করে

পুদিনা পাতায় থাকা প্রাকৃতিক উপাদান ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায়। এটি রক্তে চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে ফলে ডায়াবেটিসে উপকারী।

১০. ক্যান্সার প্রতিরোধ করে

ক্যান্সার প্রতিরোধে পুদিনা পাতা বিশেষ ভূমিকা রাখে। পুদিনা পাতায় থাকা পেরিলেল অ্যালকোহল যা ফাইটো নিউট্রিয়েন্টসের একটি উপাদান দেহে ক্যান্সারের কোষ বৃদ্ধিতে বাধা প্রদান করে।

১১. চুলের যত্নে

উকুননাশক হিসেবে কাজ করে পুদিনার শিকড়ের রস । এর পাতা বা শিকড়ের রস চুলের গোড়ায় লাগিয়ে একটি পাতলা কাপড় মাথায় পেঁচিয়ে রাখুন। এক ঘণ্টা পর চুল শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে অন্তত দুবার করলে এক মাসের মধ্যেই চুল উকুনমুক্ত হবে।

১২. শরীর ঠান্ডা করে

গরম থেকে বাঁচতে এবং শরীর ঠান্ডা করতে  সাহায্য করে পুদিনা পাতা। এর রস পান করলে শরীরে এক ধরনের ঠান্ডা অনুভূতি তৈরি হয়। ক্লান্তি দূর করে, শরীরে আসে সতেজভাব।

১৩. মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায়

পুদিনা পাতার সুগন্ধ ঘ্রাণেন্দ্রিয় দিয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছলে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি পায়। ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বেড়ে যায়। এছাড়া পুদিনা পাতায় থাকা আয়রন, পটাসিয়াম ম্যাঙ্গানিজ যা হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে এবং ব্রেনের কার্যকারিতা ও স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধি করে।

ঘরোয়া চিকিৎসায় পুদিনা পাতার ব্যবহার

১. পুদিনা পাতার চা : ১ কাপ গরম পানি, ৫-৬টি তাজা পুদিনা পাতা এবং ১ চা চামচ মধু (ঐচ্ছিক)।

গরম পানিতে পুদিনা পাতা দিয়ে ৫-১০ মিনিট ঢেকে রাখুন। এরপর ছেঁকে মধু মিশিয়ে পান করুন। এটি হজমের সমস্যা, সর্দি-কাশি ও মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবে।

২. পেটের গ্যাস ও বদহজমের জন্য

একচিমটি কালো লবণ ও অল্প জিরা গুঁড়া পুদিনাপাতার রসের সাথে মিশিয়ে খান। পেটের গ্যাস দ্রুত কমে যাবে।

৩. ত্বকের যত্নে পুদিনা প্যাক :

১০-১২টি পুদিনা পাতা, ১ চা চামচ মুলতানি মাটি, অল্প পানি এজন্য প্রয়োজন। পুদিনা পাতা বেটে পেস্ট তৈরি করে মুলতানি মাটির সাথে মিশিয়ে মুখে লাগান। ১৫ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। এটি ব্রণ ও ত্বকের তৈলাক্ততা কমাবে।

৪. মাথাব্যথা কমাতে

কপালে ও ঘাড়ে পুদিনা পাতার রস মালিশ করলে ব্যথা কমে যায়। এর রস চামড়ার ভেতরে গিয়ে নার্ভে পৌঁছে যা মাথা ব্যথা বা জয়েন্টে ব্যথা থেকে মুক্তি দেয়।

৫. ব্রণ ও ত্বকের তেলতেলে কমাতে:

মুখের ব্রণ দূর করতে ও ত্বকের তেলতেলে ভাব দূর করে। এজন্য তাজা পুদিনা পাতা বেটে ত্বকে লাগিয়ে দশ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন। ব্রণের দাগ দূর করতে রাতে পুদিনা পাতার রস লাগান। সম্ভব হলে সারারাত মুখে লাগিয়ে রাখুন । যদি সম্ভব না হয়, তাহলে কমপক্ষে ২/৩ ঘণ্টা রাখুন তারপর ধুয়ে ফেলুন। মাসখানেক এইভাবে লাগালে ব্রণের দাগ উধাও হয়ে যাবে।

৬. গরমকালে শরীরকে ঠাণ্ডা রাখাতে পুদিনার রস খুব ভাল। গোসলের আগে পানির মধ্যে কিছু পুদিনা পাতা ফেলে রাখুন। সেই পানি দিয়ে গোসল করলে শরীর ও মন চাঙ্গা থাকে।

৭. পুদিনাপাতা প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক । এর শুকনো পাতা পানিতে ফুটিয়ে, সেই পানি ফ্রিজে রেখে দিতে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়। এক বালতি পানিতে চা চামচের ১৪/১৫ চামচ পুদিনার পানি মিশিয়ে গোসল করলে গ্রীষ্মকালীন ব্যাকটেরিয়াজনিত দুর্গন্ধ কমে যায়। পুদিনা পাতার অ্যাসট্রিনজেন্ট গুণ ঘামাচি, অ্যালার্জিও দূর করে।

সতর্কতা

পুদিনা পাতা সাধারণত নিরাপদ। অতিরিক্ত সেবনে কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মহিলাদের ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। যাদের পুদিনা পাতায় অ্যালার্জি আছে তারা এড়িয়ে চলুন। অতিরিক্ত পুদিনা চা পান করলে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হতে পারে।

উপসংহার

সহজলভ্য ও গুণসম্পন্ন ভেষজ উপাদান পুদিনা পাতা বহুবিধ স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করে। হজমের সমস্যা, শ্বাসকষ্ট, ত্বকের যত্ন ও মানসিক চাপ কমাতে এটি অত্যন্ত কার্যকর। নিয়মিত পুদিনা পাতার চা বা রস খেলে প্রাকৃতিকভাবে সুস্থ থাকতে পারেন। তবে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যায় ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top