প্রতিটি মানুষের ভেতরই লুকিয়ে থাকে কিছু সুপ্ত প্রতিভা। নিজের এ প্রতিভাকে আবিষ্কার করে আত্মবিশ্বাসের সাথে এগিয়ে চললে সাফল্য আসে এবং জীবনটাকে আনন্দে উপভোগ করা যায়। জীবনে বাঁধা আসবেই সে বাঁধা পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। প্রতিভা হচ্ছে মানব জীবনের অসামান্যতা ও অসাধারণত্ব। অসামান্য উদ্ভাবনী শক্তি প্রতিভার প্রথম ও মৌলিক শর্ত। প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায় মানুষের সৃষ্টিশীল কাজে, উদ্ভাবনী শক্তিতে, বিস্ময়কর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। জটিল সমস্যার সহজ সমাধান দিয়ে, যা সাধারণ কারো পক্ষে কষ্টসাধ্য ও কল্পনাতীত বিষয়। শিল্পে, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, খেলাধুলায় সর্বত্রই প্রতিভা তার বিশেষ দ্যুতিময় অস্তিত্ব দিয়ে সর্বস্তরের মানুষকে বিমুগ্ধ ও অনুপ্রাণিত করে।
যে জিনিসটি করা একজন সাধারণ মানুষের কাছে অসম্ভব মনে হয়, সেই জিনিসটি কেউ খুব সহজে করে ফেললে সে হয় প্রতিভাবান। আর যে গুণের কারণে সে এটি করতে পারে তা হলো প্রতিভা। যে ব্যক্তি তার ভেতরের প্রতিভাকে চর্চার মাধ্যমে বাস্তবে রূপায়িত করে তিনি প্রতিভাবান। অর্থাৎ অন্তর্নিহিত ব্যতিক্রমধর্মী বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার সক্ষমতা, সৃজনশীলতা অথবা জন্মগত ও প্রকৃতিগতভাবে একে বাস্তবে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হন তিনি। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নির্দিষ্ট অনেকগুলো বিষয়ে দক্ষ বা শুধু একটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। প্রতিভার মূলে অলৌকিকত্ব, আবেগ, ইচ্ছা ও প্রেরণা যাই থাকুক না কেন সাধনা ছাড়া প্রতিভার বিন্দুমাত্র মূল্য নেই। মানুষের ভেতরর সুপ্ত অবস্থায় থাকা প্রতিভা আপনা-আপনি বের হয়ে আসে না বা প্রকাশ পায় না। এটাকে সাধনা ও কঠোর ত্যাগ ও অনুশীলনের মাধ্যমেই বের করে আনতে হয়। রুশ বিজ্ঞানী ইভান পাভলভ মনে করেন, সৃষ্টিশীলতার অপরিহার্য শর্ত হলো অসাধারণ ধৈর্য ও নিরন্তন সাধনা। মহাকবি ফেরদৌসি ত্রিশ বছর ধরে রচনা করেছেন মহাকাব্য : শাহানামা।
মানুষের ভেতরে যে সুপ্ত প্রতিভা, সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে তা শক্তিতে রূপান্তরের মাধ্যম হচ্ছে শিক্ষা। জ্ঞানানুশীলন, নিরবচ্ছিন্ন অধ্যবসায় ও কঠোর সাধনা, পরিশ্রম ইত্যাদি প্রতিভা বিকাশের জন্য প্রয়োজন। যে ব্যক্তি যত বেশি জ্ঞানচর্চা করবে, সাধনা করবে, নিরলস পরিশ্রম করবে, সে তত বেশি তার প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারবে। প্রতিভা ও সাধনা একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। বিধাতা প্রদত্ত বিবেক, জ্ঞান, বুদ্ধি, শক্তি যথাযথ কাজে লাগাতে না পারলে যেমন জীবনে কিছুই করা যায় না। ঠিক একইভাবে প্রতিভার ওপর সবকিছু ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে কোনো কিছুই আশা করা যায় না।ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সমাজের নানা রকম বিপর্যয় বিপ্লব, গণজাগরণ অভ্যুদয়, যুদ্ধ সবকিছুকে উপেক্ষা করেও প্রতিভা বিকাশের জন্য নিরঙ্কুশ সাধনা করেছেন। একজন মা যেমন তার ছোট্ট অবুঝ না জানা, না বোঝা শিশুকে অধিক আদর স্নেহে লালন পালন করে বড় করে তোলেন। ইতিহাস খুলে দেখলেই দেখা যায় পৃথিবীর সব প্রতিভাবান ব্যক্তিও ঠিক একইভাবে তার ভেতরের প্রতিভাকে লালন-পালন করে জাগ্রত করেছেন এবং ক্রমান্বয়ে নিজেকে একজন প্রতিভাবান হিসেবে বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করেছেন। যত্ন না করলে প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটে।
প্রতিভাকে কলমের কালির সাথে তুলনা করা যায়।কালি ফুরিয়ে যাওয়া কলম দিয়ে সারা দিন কোনো খাতায় লিখলেও খাতাটি সাদা দেখা যায়, লেখার কোনো চিহ্ন থাকে না। সারাদিন সেটা দিয়ে লেখা পণ্ডশ্রম। এখানে কলমের কালিই হলো প্রতিভা। প্রতিভা সবার মধ্যে থাকে না। তাই তো প্রতিভার সন্ধান পেলে সেটার সঠিক পরিচর্যা করতে হয়। তার যথাযথ বিকাশের সুযোগ দিতে হয়।বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিতে হয়।তবেই প্রতিভা তার সম্পূর্ণ স্পৃহা নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে এবং সেই প্রতিভাই সম্ভাবনাময় প্রাচুর্যপূর্ণতা দান করে মানবজাতিকে কল্যাণের পথে নিয়ে যেতে পারে। মানুষকে কৌতুহলী হতে হয়। যে যত বেশি কৌতুহলী সে তত বেশি জানতে পারে। জটিল বিষয় তার কাছে সহজ মনে হয়। দ্রুত আয়ত্ব করা তার জন্য সহজ।
শিশু অবস্থায় তাদের মধ্যে শিক্ষার প্রতি অনুরাগ জন্মাতে হবে। তাদের ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও সুপ্ত প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। বাবা-মা, শিক্ষক, অভিভাবকদের যত্নবান ও সহনশীল হতে হবে। কঠোর শাসন, নিয়ন্ত্রণ, প্রতিকূল পরিবেশ শিশুর জীবনকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়। অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ না করে আনন্দের মধ্য দিয়ে সুপ্ত প্রতিভাকে প্রষ্ফুটিত করার সুযোগ দিতে হবে। তবেই শিশু ফুলের মতো বিকসিত হবে। অনুকূল পরিবেশ পেলে যে কোনো শিশু তার প্রতিভা বিকাশে সচেষ্ট হয়। শিশুরা শিখবে ঘরে-বাইরে, বিদ্যালয়ে, খেলার মাঠে, সমাজ থেকে নিজেদের মতো করে। শিশুর প্রতিভা বিকাশে পরিবারকেই প্রথম উদ্যোগ নিতে হবে। কেননা প্রথম শিক্ষা পরিবার থেকেই মানুষ নেয়। শিশুর চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রতিভা বিকাশে সচেষ্ট হতে হবে। অস্বচ্ছল পরিবার তার শিশুদের প্রতিভা বিকাশের পরিবেশ দিতে পারে না আর্থিক, পারিপার্শ্বিক কারণে সেক্ষেত্রে সরকার ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে প্রতিভার বিকাশ ঘটানোর নিরাপদ আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি করতে।
বুকে সাহস মনে বিশ্বাস, বিজয় মালা তাতে প্রকাশ।প্রতিভা হলো অনন্ত ধৈয্য।কবিতার সুরে বলা যায়-
ধৈয্য ধরে কাজ করে যাও,
প্রত্যাশিত ফল তুলে নাও।
প্রতিভাবানরাই সমাজ ও সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যান। তারাই মূলত সময়ের বিবেক। তারা অগ্রভাগে থাকেন। সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেন। সাহসের জোগান দেন। সামাজিক দায়িত্ব বোধকে জাগ্রত করেন। সকলের উচিত প্রতিভার সঠিক পরিচর্চা ও প্রতিভাবানদের সঠিক সম্মান প্রদর্শন করা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছিলেন। ‘যে দেশে গুণের কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মায় না।’- আর তাই গুণী ব্যক্তিদের যথাযথ সম্মান করতে হবে। গুণের পরিচর্চা করেই সে গুণকে পরিবর্ধন করা প্রয়োজন। প্রতিভার আলোয় আলোকিত করতে হবে সারা দেশ, সমাজ তথা পুরো বিশ্বকে।
আমাদের প্রতিভা ও সামর্থ্যকে চিনতে হবে এবং মেধাকে পূর্ণ সম্ভাবনায় বিকশিত করতে হবে। প্রতিটি মানুষেরই প্রতিভা, ক্ষমতা, দক্ষতা আছে যার মাধ্যমে সে জীবনে সফল হতে পারে। সুপ্ত প্রতিভাকে চেনা বেশ কঠিন কাজ। গতানুগতিক ধারার জীবনযাপন, পড়ালেখা বা ক্যারিয়ারে মনোনিবেশ করতে যেয়ে নিজের প্রতিভাকে বেশিরভাগ মানুষই অবহেলা করে। ফলে অধিকাংশের মনের মাঝে অসন্তুষ্ট বা অতৃপ্তি থাকে। নিজের ভেতরে থাকা সুপ্ত প্রতিভাকে খুঁজে নিতে হলে
১. নিজেকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আগ্রহকে মূল্যায়ন করতে হবে, শখকে গুরুত্ব দিতে হবে। আগ্রহের বিষয়গুলোর তালিকা তৈরি করে দেখুন। স্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করা ও কাজ করা।
২. স্রোতের বিপরীতে ভাবতে হবে- ঝুঁকি নিতে হবে, কখনোই ভীত হওয়া যাবে না।
৩. নিজের দক্ষতা ও দুর্বলতাকে জানতে হবে। ধৈর্য, চিন্তা ও একাগ্রতার মাধ্যমে নিজ দক্ষতা ও দুর্বলতাগুলোকে চিহ্নিত করুন যা সেলফ ডেভেলপমেন্টেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৪. প্রতিভার যত্ন নিন। কৌতুহলী হোন ও মুক্তমনা হোন।
৫. সৃজনশীল কাজে সম্পৃক্ত হওয়া।
৬. পরিবর্তন ও নতুন কিছু করার চিন্তা চেতনা লালন করা
৭. নিজেকে চিন্তাশীল হিসেবে গড়ে তোলা
৮. তথ্য ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো
সবশেষে বিখ্যাত মার্শাল আর্টিস্ট ব্রুস লী-র কথা বলতে চাই। তিনি বলতেন- ”আমাদের সব সময় বলা হয় যে প্রতিভা সুযোগ সৃষ্টি করে, অথচ ইচ্ছাই প্রতিভা সৃষ্টি করে।” তাই ইচ্ছা চেষ্টা ও আত্মবিশ্বাসের সাথে এগিয়ে চলুন জীবনে সফলতা আসবে।