হিংসা থেকে মুক্তি : কামরান চৌধুরী

হিংসা আত্মার রোগ। হিংসা হলো কারো কল্যাণ দেখে অন্তরে জ্বালা অনুভব করা এবং তার ক্ষতি করার জন্য চেষ্টা করা। ইসলামের দৃষ্টিতে এটি অত্যন্ত গুনাহের কাজ ও নিন্দনীয় বিষয়। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সুরা নিসা ৫৪ আয়াতে বলেন- আল্লাহ দয়া করে মানুষদেরকে যা দান করেছেন সে বিষয়ে এরা কি তাদেরকে হিংসা করে।” রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমরা পরস্পর হিংসা করো না। কারও জ্ঞানবুদ্ধি, অর্থসম্পদ, মান-ইজ্জত, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ইত্যাদি ভালো কিছু দেখে মনে কষ্ট লাগা এবং আকাক্ষা করা- সেটা তার না থাকুক বা ধ্বংস হয়ে যাক এবং বাস্তবে সত্যি সত্যি তেমনটি ঘটলে মনে আনন্দ অনুভূত হওয়ার মনোবৃত্তিকেই হিংসা বলা হয়।

হিংসা-বিদ্বেষ মানব চরিত্রের অত্যন্ত নিন্দনীয় অভ্যাস। এটি মানব চরিত্রকে ধ্বংস করে দেয়। হিংসুক ব্যক্তি কখনোই সৎচরিত্রবান হতে পারে না। কেননা গর্ব-অহংকার, পরশ্রীকাতরতা, শত্রুতা, অন্যের অনিষ্ট কামনা ইত্যাদি হিংসার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। হিংসুক ব্যক্তির মধ্যে এসব অভ্যাসও গড়ে ওঠে। হিংসুক ব্যক্তি নিজেকে বড় মনে করে, নিজের স্বার্থকে সবচেয়ে বড় করে দেখে। সে অন্যকে ঘৃণা করে, অন্যের প্রতি শত্রুতা পোষণ করে, অন্যের অনিষ্ট কামনা করে। এতে মানব সমাজে ঐক্য, সংহতি বিনষ্ট হয়, শান্তি-শৃঙ্খলা ব্যাহত হয়।”হিংসা নেক আমল ধ্বংস করে দেয়।

সাধারণত নিজের বড়ত্ববোধ বা শত্রুতা থেকে হিংসার মনোভাব সৃষ্টি হয়। মূলত কারও উচ্চাশা যখন পূরণ না হয়, জীবন সংগ্রামে যখন সে অন্যের তুলনায় পেছনে পড়ে অথবা উন্নতি-সমৃদ্ধি বা পদমর্যাদা লাভ করতে পারে না অথচ অন্য কেউ তার স্থান দখল করে একের পর এক সাফল্যের সিঁড়ি অতিক্রম করতে থাকে, তখন তার হৃদয়ে হিংসার আগুন জ্বলে ওঠে। এ অবস্থায় পিছিয়ে পড়া ব্যক্তি হিংসার আগুনে জ্বলতে জ্বলতে অসৎ চিন্তাভাবনায় নিমজ্জিত হয়। ঘুম হারাম হয়ে যায়। সারা রাত পার করে সাফল্য লাভকারীর ধ্বংস কামনায়। এমন হিংসুক ব্যক্তি চিরকাল অতিশয় মনোকষ্টে দিনযাপন করতে থাকে ও সফল ব্যক্তির ক্ষতি সাধনে লিপ্ত হয়।

প্রকৃতপক্ষে হিংসা অত্যন্ত নিচু মানসিকতার পরিচায়ক ও নোংরা চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ। হিংসুক সামাজিকভাবেও ঘৃণার পাত্র। সে নিজেই নিজের শত্রু। সে কখনো মানসিকভাবে শান্তি পায় না। সে অন্যের কল্যাণ দেখে অন্তরজ্বালায় দগ্ধ হতে থাকে। আল্লাহ তাআলা সূরা ফালাকে হিংসুকের হিংসা থেকে আশ্রয় চাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। (আল্লাহর নিকট হিংসুক থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।)

হিংসা, ক্রোধ, ভয় জীবনের পরম শত্রু। হিংসা থেকেই অধিকাংশ কুৎসা রটিত হয়। তোমরা হিংসা করা থেকে আত্মরক্ষা করো । হিংসা মানুষকে নিচে নামিয়ে দেয়। হিংসা নয়; ঈর্ষা করা যায়। কারো কল্যাণ ও ভালো কিছু দেখে তার ক্ষতির চিন্তা না করে তার অনুরূপ বা তার চেয়ে বেশি কল্যাণ প্রত্যাশা করা এবং তা অর্জনের চেষ্টা-সাধন করাই হলো ঈর্ষা। হিংসা নিজের ছাড়া অন্য কারো ক্ষতি করতে পারে না। হিংসা নিজের আত্মাকে ছোট করে, অন্যের ক্ষতি করার প্রবণতা বাড়ায়। হিংসা করলে কখনো সুখী হতে বা প্রশান্তি লাভ করতে পারবেন না। মরিচা লোহাকে বিনষ্ট করে দেয়, তেমনি হিংসা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়। হিংসা এবং পরশ্রীকাতরতা মানুষকে মানুষের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ এবং হানাহানিতে লিপ্ত করে। ব্যর্থ মানুষেরা বেশিরভাগ সময় হিংসা করে। তবে সফল মানুষও হিংসা করে যা তাদেরকে আরো কর্মমূখী করে ও সফলতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

আগুন নেভাতে যেমন পানির প্রয়োজন তেমনি হিংসা দূর করতে ভালোবাসা প্রয়োজন। যার মধ্যে ধৈর্য, ক্ষমা ও সহানুভূতির অভাব বেশি, তার হৃদয়ে ততবেশি হিংসা নামক মনোরোগটির প্রকোপও বেশি। নিজেকে হিংসুটে পরিচয় দেয়া থেকে বিরত থাকাই উত্তম।

হাদিসে বলা হয়েছে,‘তিন ব্যক্তির গুনাহ মাফ হয় না, তার মধ্যে একজন হচ্ছে অন্যের প্রতি বিদ্বেষ–পোষণকারী ব্যক্তি।’ হিংসা-বিদ্বেষের কঠিন পরিণতি সম্বন্ধে মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘প্রতি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার মানুষের আমলগুলো পেশ করা হয় এবং সব মুমিন বান্দার গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়; কিন্তু যাদের পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষ ও দুশমনি আছে, তাদের ক্ষমা করা হয় না।’ (মুসলিম শরিফ)

পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ পরিত্যাগ করা। বিশ্বের সব সৃষ্টির সেবা ও জনকল্যাণ কামনাই হলো ইসলামের অনুশীলন। নিজের যা কিছু আছে, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। অন্যের দিকে তাকিয়ে বিদ্বেষ পোষণ করে হিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ নেই। অন্যের সুখ, শান্তি ও ধন–সম্পদ বিনষ্ট বা ধ্বংস করে নিজে এর মালিক হওয়ার বাসনাকে আরবিতে হাসাদ বা হিংসা বলা হয়। ইসলাম অন্যের প্রতি হিংসা করাকে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে।

হিংসার ব্যাধি থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহভীরু আলেমরা কয়েকটি উপায় বলে দিয়েছেন। তা হলো- ১. যার প্রতি হিংসা হবে, তার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করতে থাকা; ২. লোকসমাজে তার প্রশংসা করা; ৩. তাকে হাদিয়া বা উপহার দেওয়া। হাদিসে আছে, ‘তোমরা একে অন্যকে হাদিয়া দাও। এর দ্বারা মনের কালিমা দূর হয়’ (তিরমিজি); ৪. সালামের আদান-প্রদান করা। সালাম দ্বারা পরস্পর মহব্বত বৃদ্ধি পায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি কি তোমাদের এমন আমলের কথা বলে দেব, যার দ্বারা তোমাদের মধ্যে ভালোবাসার সৃষ্টি হবে। সেটা হলো পরস্পর বেশি বেশি সালামের আদান-প্রদান করা’ (মুসলিম); ৫. মনে মনে এই চিন্তা করা যে, আল্লাহ তায়ালা আমাকে এমন কিছু দিয়েছেন যা তাকে দেননি। আর আমি তো হিংসা করে তার নেয়ামত দূর করতে পারব না। এভাবে চিন্তা করলে এবং উপরোক্ত উপায়গুলো অবলম্বন করলে ধীরে ধীরে হিংসা রোগ অন্তর থেকে দূর হয়ে যাবে, ইনশাআল্লাহ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top