কবিতা কি ? কবিতার বৈশিষ্ট ও কবিতার প্রকারভেদ

কবিতা শব্দের ছন্দোময় বিন্যাস। মনের ভাব ছন্দের মাধ্যমে প্রকাশ করাকেই কবিতা বলে। মানুষের হৃদয়ের কথা, মনের কথা, ভালোবাসার কথা, সুখ-দুঃখের কথা, দেশের কথা, দশের কথা, প্রকৃতির কথা, আবেগ-অনভূতির কথা প্রভৃতি ছন্দে ছন্দে প্রকাশ করাই হলো কবিতা। যিনি কবিতা লিখেন তিনি কবি। কবির হৃদয়ই কবিতার জন্মভূমি। কোনো একটি বিষয় বা সূত্রকে অবলম্বন করে কবির আনন্দ বেদনা যখন প্রকাশের পথ পায় তখনই কবিতার জন্ম।

জগতের রূপ-রস, স্পর্শ-শব্দ, মনের ভাব-সুখ-ব্যথা, অনুভূতি কল্পনাকে যিনি   সংক্ষেপে এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সাহায্যে উদ্ভাসিত করে স্নিগ্ধ ছন্দোময় শিল্পরূপ সুমধুর শ্রুতিযোগ্যতা যুক্ত করে দিতে পারেন তিনিই কবি। কবি হতে হলে নিজ প্রাণে, অন্য প্রাণে ও প্রকৃতির মাঝে প্রবেশ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। কবি বিশ্বহৃদয়েরই অংশ।  কবিতা জীবনবোধের সুতীব্র প্রকাশ। কবি মনের অবচেতন অংশে প্রাধান্যবিস্তারকারী চিন্তা, অনুভূতি ও ইচ্ছাগুলো শোভন রূপে কবিতায় প্রকাশ করা হয়। অলংকার, ধ্বনিব্যঞ্জনা, ভাব, রস কবিতাকে সমৃদ্ধ ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে রাখে।

কবিতা হলো সত্য ও সুন্দরের যুথবদ্ধ মিলন। শব্দ এবং অর্থের যথার্থ মিলনের ফলেই কবিতার জন্ম হয়। কবির উপলব্ধিজাত শিল্পভাবনাই কবিতা। কবির সৌন্দর্য্যভাবনার বহিঃপ্রকাশের এক সৃষ্টি এই কবিতা। কবি মনে ভাব ও ভালোবাসার জাগরণ ঘটায়, চিন্তা চেতনাকে জাগ্রত করে। কবিতা  সৎ জীবনভাবনা, সতত প্রেরণা ও মানবকে সৃষ্টিশীল করে তোলে। কবিতা মানুষকে ভালবাসতে শেখায়, প্রতিবাদী হতে সাহায্য করে। কবিতা  নির্মল আনন্দ দেয়। কবিতা কবির শিক্ষা, সংস্কৃতি, চেতনার পরিচয় প্রদান করে। কবিতা পাঠে মন-প্রাণ সমৃদ্ধ হয়। কবিতা আমাদের আত্মসংস্কৃতিকে ও জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে। কবিতা রচনা করলে প্রজননের স্বাদ পাওয়া যায়। যখন একটি কবিতা সৃষ্টিকর্ম চলে তখন কবি একজন অসহায় আর দ্বিধাদ্বন্দ্বে অস্থির পোয়াতি নারীর মতো।

ছন্দই কবিতার প্রাণ। কবিতার অপরিহার্য অঙ্গ তার অলংকার। কবিতার মধ্যে কবির কল্পনাশক্তির প্রকাশ, অনুভূতির উচ্ছ্বাস বাণীমূর্তিতে ধরা পড়ে। নারী যেমন আকার -সাকারে, ইঙ্গিতে, সাজসজ্জায়,রং-চঙ্গে, বিলাস-প্রসাধনে নিজেকে আকর্ষনীয় করে তোলে(!) কবিতা ও তেমনি শব্দে, মায়ায় , মর্মে ছন্দে উপমায় চিত্রে ও অনুভূতির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করে। কবির জীবন কবিতার ওপর বিশাল প্রভাব রাখে। কবিকে খুঁজে পাওয়ার একমাত্র জায়গা হচ্ছে তার কবিতা।

কবিতা প্রধানত দুই ভাগে বিভক্ত। মন্ময় কবিতা ও তন্ময় কবিতা। কবি যখন একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি, অভিজ্ঞতা, ভাবনা, চিন্তা তার কাব্যে সামগ্রিক রূপে গ্রহণ করে আত্মপ্রকাশ করেন তখন সেই অমর সৃষ্টিকে মন্ময় কবিতা বলে। মন্ময় কবিতা ব্যক্তিনিষ্ঠ। কবির অন্তরের অনুভূতির দিকগুলো মন্ময় কবিতায় ধরা পড়ে। কাব্যতত্ত্ব, সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা এবং রস সৌন্দর্যের বিচারে মন্ময় কবিতাই শ্রেষ্ঠ।

কবি যখন বস্তুজগৎকে কাব্যিক রূপে প্রকাশ করেন, তখন তাকে তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ কবিতা বলে। জগৎ-সংসার বা বস্তুবিশ্বের কোনো বিষয় যখন কবি হৃদয়ে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে কবির অনুভূতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করে তখনই তন্ময় কবিতার সৃষ্টি। তন্ময় কবিতায় বস্তুসত্তাই প্রধান। আলংকারিক ভাষার নৈপুণ্য, ছন্দের জাদুকরী বৈচিত্র্য, ভাবের ব্যঞ্ছনা ও কল্পনার চমৎকারিত্বই হলো তন্ময় কবিতার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।

একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট, ঘটনাকে রূপকধর্মী ও নান্দনিকতা সহযোগে কবিতা রচিত হয়। যুগ-যুগ ধরে কবিরা তাদের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনাগুলোকে মনের মাধুরী মিশিয়ে সৃষ্টি করে চলেছেন নিত্য-নতুন কবিতা। কবিতাগুলো একত্রিত করে তাঁরা কবিতাসমগ্র বা কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন।

কবিতা তো শুধু একান্তে পড়বার নয়, অন্যকে শোনাবারও। কবিতার শিল্পবোধ ও সৌন্দর্যতৃষ্ণাই তাঁকে কবিতার কাছে নিয়ে যায়। কবিতা এক ধরনের আশ্রয়। মানুষ সেখানে স্বস্তি, সান্তনা, সমর্থন ও আনন্দ সন্ধান করে। মানুষ কবিতায় প্রতিবাদ প্রত্যাশা করে, চায় ধ্বনির যাদু, শব্দের মোহন বাজনা এবং আরো অনেক কিছু। কবিতায় খোঁজে আবেগের অভিনব প্রকাশ, জীবনের গূঢ় সত্য এবং অপার্থিব শান্তি। জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে কবিতা সাহায্য করে। কবিতা সমাজ সংস্কারের হাতিয়ার। কবিতা লিখতে গেলে যে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়, করতে হয় সাধনা। কবিতা লিখতে গেলে যে প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়, করতে হয় সাধনা। মানুষের সুকুমার বৃত্তির জায়গা এখন দখল করে নিচ্ছে আকাশ-সংস্কৃতি ও যান্ত্রিকতা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top