ক্ষমা মহৎ গুণ : কামরান চৌধুরী

ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ। ক্ষমা শব্দটি প্রায়ই সংস্কৃত গ্রন্থে কৃপা (কোমলতা), দয়া ও করুণা এর সাথে মিলিত হয়। যে ব্যক্তি ক্ষমা করে না সে ভুলের স্মৃতি, নেতিবাচক অনুভূতি, রাগ এবং অমীমাংসিত আবেগের থলে বহন করে যা তাদের বর্তমান এবং ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করে। আপনি ক্ষমা করবেন নিজের মনের প্রশান্তির জন্য। ক্ষমার মাধ্যমে অতীত পরিবর্তন করা যায় না ঠিকই কিন্তু ভবিষ্যতকে সুন্দর আনন্দময় ও বড় করতে পারা যায়।

গাফুর আরবি শব্দের আভিধানিক অর্থ ক্ষমা। ইসলামী পরিভাষায় অন্যায় অত্যাচার ও উৎপীড়নের প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও করুণা দেখিয়ে অপরাধীকে ক্ষমা করে দেয়া ও তার প্রতি সহনশীলতা ও উদারতা প্রদর্শন করাকে আ’ফউ বা ক্ষমা বলা হয়। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি সর্বদা তার বান্দাদের অপরাধ ক্ষমা করে থাকেন। তাই গফুর ও গাফফার নামে তাকে অভিহিত করা হয়। আল্লাহ যদি তার বান্দাদের ক্ষমা না করতেন তাহলে দুনিয়াতে কোনো মানুষই রেহাই পেত না। এজন্য যে ব্যক্তি আল্লাহর ক্ষমা গুণ অবলম্বন করে অপর মানুষের অপরাধ ক্ষমা করে, আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন।

জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ অন্যের রূঢ় বা কটু কথাবার্তা কিংবা অশোভনীয় আচার-আচরণে কষ্ট পেয়ে থাকেন। ফলে একে অপরে মতবিরোধ তৈরি হয়। অনেক সময় মতবিরোধ ও মতানৈক্যকে কেন্দ্র করে পরস্পরের মধ্যে সংঘাত ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। পবিত্র কোরআনে সুরা নিসা-এ আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা যদি কল্যাণ করো প্রকাশ্যভাবে কিংবা গোপনে অথবা যদি তোমরা অপরাধ ক্ষমা করে দাও, তবে জেনে রেখো আল্লাহ নিজেও ক্ষমাকারী, মহাশক্তিমান। ক্ষমা মানব জীবনের পরম আদর্শ ও মহাগুণ। মহান আল্লাহ ক্ষমাশীল। তিনি বান্দাদের ক্ষমা করতে পছন্দ করেন। তাই তিনি তাঁর প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সা:কে এই গুণ অর্জনে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘‘ক্ষমা করার অভ্যাস গড়ে তোলো, ভালো কাজের আদেশ দাও এবং মূর্খ জাহেলদের (কথাবার্তা) থেকে দূরে থাকো।’’ (সূরা আ’রাফ : ১৩৪)

ভুল করার প্রবণতা মানুষের মজ্জাগত। মানুষের ভুল হবেই তবে ক্ষমা করতে পারা হলো স্বর্গীয়। মানব সৃষ্টির শুরুতে স্বর্গ থেকে মর্তে মানুষের আগমনও কিন্তু ভুল থেকেই। ভুল আচরণ-উচ্চারণ নিজ বা অন্য যে কারও থেকেই ঘটতে পারে। আমরা সবাই ক্ষমা বা ছাড় পছন্দ করি। সমাজ জীবনে বাঁচতে হলে মানুষকে ক্ষমা ও ছাড় দিয়েই চলতে হবে। অজ্ঞ মূর্খদের সর্বদা ক্ষমা করতে হবে। আল্লাহ তাআলা ক্ষমাশীল ব্যক্তিকে ভালোবাসেন। মুমিনের সবচেয়ে বড় গুণ হলো ক্ষমা করতে পারা। ক্ষমা করা দৃঢ় সংকল্প ব্যক্তিত্বের পরিচারক। ক্ষমা ব্যতিরেকে এ জগত সংসার অচল হতে বাধ্য।

ক্ষমা ছাড়া জীবন যেন কারাগার। তাই ক্ষমা করতে হবে, কিভাবে ক্ষমা করতে হয় তা শিখতে হবে। সবচেয়ে সুন্দর ক্ষমা হলো বকা না দিয়ে কাউকে ক্ষমা করা। কাউকে ভালোবাসতে হলে আগে ক্ষমা করতে শিখতে হয়। দুর্বলেরা কখনোই ক্ষমা করতে পারে না। ক্ষমা শুধুমাত্রই শক্তিশালীরাই করতে পারে।  ক্ষমা ভালোবাসার সবচেয়ে বড় রূপ, যার প্রতিদানে হাজারো ভালোবাসা পাওয়া যায়। ক্ষমা করার অর্থ আপনি তাকে সুযোগ দিচ্ছেন নতুন কিছু, ভালো কিছু করার। মানুষের মাঝে সম্পর্ক তখনই মজবুত দৃঢ় হয় যখন তারা নিজেদের ভুলগুলোকে ক্ষমা করতে শেখে। মানুষ তখনই একসাথে থাকতে পারে যখন সে অন্যের ভুল ক্ষমা করতে পারে। যারা ক্ষমা করতে জানে না তারা কোটি মানুষের ভিড়েও একা একাই থেকে যায়।

আলবার্ট আইনস্টাইন বলেন, দুর্বল লোকেরা প্রতিশোধ নেয়, শক্তিশালীরা ক্ষমা করে দেয় এবং বুদ্ধিমানরা এড়িয়ে চলে। ভুলে গেলে চলবে না যে, মানুষের কাছে তিনটি শক্তিশালী সম্পদ রয়েছে যা হলো- ভালোবাসা, প্রার্থনা আর ক্ষমা। যিনি উদার, তিনিই ক্ষমাশীল। যাদের এ গুণাগুণ আছে, তারা আল্লাহর বিশেষ নিয়ামতপ্রাপ্ত। ক্ষমাকারী ব্যক্তি ধৈর্যবান ও সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তায়ালা সূরা শুরার ৪০ আয়াতে বলেন, ‘আর মন্দের প্রতিফল মন্দ। অতঃপর যে ক্ষমা করে দেয় এবং আপস নিষ্পত্তি করে, তার পুরস্কার আল্লাহর কাছে রয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ জালিমদের পছন্দ করেন না’। মিশকাত শরীফে আছে- আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- আরেকটি রেওয়ায়েতে রাসূলুল্লাহ সা: সহিষ্ণুতার মর্যাদা তুলে ধরে বলেন, ‘হজরত মূসা আ: আল্লাহ তায়ালাকে জিজ্ঞেস করেন, হে রব! তোমার কাছে কোন বান্দা বেশি মহিমান্বিত? জবাবে আল্লাহ বলেন, যে ব্যক্তি প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমা করে দেয়’ । ক্ষমার অনেক উপকার রয়েছে-

১. ক্ষমা আল্লাহ প্রদত্ত বিশেষ নিয়ামত। যে ক্ষমা করে সে ওই বিশেষ নিয়ামতে নিজেকে ধন্য করে। ২. ক্ষমা করা রাসূলুল্লাহ সা:-এর শ্রেষ্ঠ আদর্শ। যে ব্যক্তি ক্ষমা করে সে রাসূলুল্লাহ সা:-এর শ্রেষ্ঠতম উম্মত। ৩. ক্ষমাশীলতা ব্যক্তকে প্রকৃত মানবে রূপান্তর করে, মানবিকতার গুণে গুণান্বিত করে। ৪. ক্ষমা ব্যক্তিকে সহনশীল ও ধৈর্যশীল করে তোলে। ৫. ক্ষমা ব্যক্তিকে সমাজে পরম সম্মানিত করে তোলে। ৬. ক্ষমা দ্বারা চরম শত্রু পরম বন্ধু হয়ে যায়। ৭. ক্ষমাকারী ব্যক্তি মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিয়ে সমাজে চলতে পারে। ৮. ক্ষমা অনেক সময় বীরত্বের চেয়েও শ্রেষ্ঠতম বিবেচিত হয়। ৯. ক্ষমার মাধ্যমে শত্রুতা মনোভাব দূরীভূত হয়। ১০. ক্ষমার মাধ্যমে অসংখ্য সওয়াব ও ভালোবাসা অর্জিত হয়। ১১. ক্ষমা মান-মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়। কাউকে ক্ষমা করে একজন মানুষ সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠে।

সবশেষে বলতে চাই পরিবারিক, সামাজিক ও জীবনের অন্যান্য পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ে মতবিরোধ দেখা যাওয়া স্বাভাবিক। তবে এমন হলে, মুসলমান হিসেবে প্রত্যেকের দায়িত্ব হলো অন্যকে ক্ষমা করে দেওয়া। পারস্পরিক ভুল-ত্রুটিগুলোকে শুধরে দেওয়া। এতে সম্পর্ক ও বন্ধন আরো মজবুত ও অটুট হয়। আল্লাহ সবাইকে ক্ষমাশীল হওয়ার তাওফিক দান করুক।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top