ছোটগল্প-কি-ছোটগল্পের-বৈশিষ্ট্য-ও-লেখার-কৌশল.

ছোটগল্প কাকে বলে? ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য ও লেখার কৌশল

ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের একটি জনপ্রিয় শাখা, যা অল্প কথায় জীবনের গভীর সত্য বা অভিজ্ঞতা প্রকাশ করে। একটি ভাল ছোটগল্প পাঠকের মনে এক গভীর ছাপ ফেলে, চিন্তার খোরাক জোগায় এবং কখনো কখনো মনের গহীনে এক অদ্ভুত আলোড়ন তোলে

ছোটগল্প কাকে বলে?

ছোটগল্প হলো এমন এক ধরনের গদ্যসাহিত্য যা তুলনামূলকভাবে ছোট আকারে রচিত হয়। এতে সাধারণত একটি বা দু’টি চরিত্র, একটি নির্দিষ্ট ঘটনা বা সংকট এবং একটি নির্দিষ্ট স্থান ও সময়ের প্রেক্ষাপট থাকে। ছোটগল্প মূলত ঘটনার গভীরতা, চরিত্রের মানসিক দ্বন্দ্ব, কিংবা কোনো জীবনঘনিষ্ঠ বার্তার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। ছোটগল্প একটি সংক্ষিপ্ত আখ্যানধর্মী সাহিত্যকর্ম, যা সাধারণত একটিমাত্র কেন্দ্রীয় ঘটনা বা চরিত্রকে ঘিরে আবর্তিত হয়। এটি অল্প পরিসরে গভীর আবেগ, সংঘাত বা বার্তা প্রকাশের জন্য উপযোগী। আজ আমরা ছোটগল্প ককে বলে, ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য ও লেখার কৌশল সম্পর্কে জানবো

ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্যসমূহ

ছোটগল্পের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো:

১. সংক্ষিপ্ততা :

ছোটগল্প নামেই বোঝা যায় এটি “ছোট”। কিন্তু এই ছোট বলতে শুধু শব্দসংখ্যা বোঝানো হয় না, বরং এতে অপ্রয়োজনীয় বিবরণ, ব্যাখ্যা বা অতিরিক্ত দৃশ্য বর্জন করা হয়। সাধারণত ৫০০ থেকে ৫০০০ শব্দের মধ্যে একটি ছোটগল্প সীমাবদ্ধ থাকে, যদিও ব্যতিক্রমও দেখা যায়।

২. একক প্লট বা একক কেন্দ্রীয় ঘটনা :

ছোটগল্পে সাধারণত একটি মাত্র কেন্দ্রীয় প্লট থাকে। এখানে উপন্যাসের মত একাধিক সাব-প্লট থাকে না। একটি প্রধান ঘটনা বা সংঘাতকে কেন্দ্র করে গল্প এগিয়ে যায়।

৩. সময় ও স্থান সীমাবদ্ধতা :

ছোটগল্পে সময়কাল ও স্থান সাধারণত নির্দিষ্ট থাকে। এতে ঘটনাপ্রবাহ দীর্ঘ সময়জুড়ে বিস্তৃত হয় না।

৪. সীমিত চরিত্র –

অল্প সংখ্যক চরিত্র থাকে, যাদের মধ্যে এক বা দুটি প্রধান হয়।

৫. গতিশীল প্লট –

দ্রুত সূচনা, সংঘাত ও সমাধানের মাধ্যমে গল্প শেষ হয়।

৬. শক্তিশালী সমাপ্তি

– শেষে প্রায়ই অপ্রত্যাশিত মোড় বা গভীর বার্তা থাকে।

৭. বাস্তবতা বা প্রতীকী অর্থ

– সামাজিক, মানবিক বা মনস্তাত্ত্বিক বিষয় ফুটিয়ে তোলা হয়।

ছোটগল্প কিভাবে লিখতে হয়?

১. বিষয় নির্বাচন :

জীবনের কোনো বিশেষ মুহূর্ত, অনুভূতি বা সামাজিক সমস্যা বেছে নিন। যেমন: প্রেম, বিচ্ছেদ, দারিদ্র্য বা স্বপ্ন। দুর্ঘটনাও হতে পারে সেই সময়ের বাস্তব বর্ণনা।

২. চরিত্র সৃষ্টি :

প্রধান চরিত্রের নাম, বয়স, ব্যক্তিত্ব ও লক্ষ্য ঠিক করুন। পার্শ্বচরিত্রগুলোকে সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করুন।

৩. প্লট ডেভেলপমেন্ট :

সূচনা: পরিবেশ ও চরিত্র পরিচয় দিন।

মধ্যাংশ: সংঘাত বা সমস্যা উপস্থাপন করুন।

শেষাংশ: সমাধান বা অপ্রত্যাশিত টুইস্ট দিন।

৪. ভাষা ও শৈলী :

সরল ও প্রাণবন্ত ভাষা ব্যবহার করুন। বর্ণনামূলক দৃশ্য তৈরি করতে রূপক বা উপমা ব্যবহার করুন।

৫. সম্পাদনা :

অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিয়ে গল্পকে সংক্ষিপ্ত ও প্রাণবন্ত করুন। ছোটগল্প এক বসাতেই লিখে ফেলতে পারেন। সেটা রেখে দিন কিছুদিন। এরপর এটাকে সম্পাদনা করুন। অপ্রয়োজনীয় কিছু অংশ বাদ দিন। কিছু সংযোজন করুন গল্পের খাতিরেই।

বিশ্বসেরা কিছু ছোটগল্প লেখক এবং তাদের রচিত উল্লেখযোগ্য ছোটগল্পসমূহ-

১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – কাবুলিওয়ালা, পোস্টমাস্টার, ছুটি, সমাপ্তি, হৈমন্তী, স্ত্রীর পত্র;

২. অ্যান্টন চেখভ (রাশিয়া)– দ্য লেডি উইথ দ্য ডগ, ওহেনকা, দ্যা ডেথ অব দ্যা গভর্নমেন্ট ক্লার্ক

৩. এডগার অ্যালান পো (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)– দ্য টেল-টেল হার্ট, দ্য ফল অব দ্য হাউস অব অ্যাশার, দ্যা ক্যাঙ্ক অব অ্যামন্টিলাডো;

৪. আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)- দ্য ওল্ড ম্যান অ্যাট দ্য ব্রিজ, আ ক্লিন, ওয়েল-লাইটেড প্লেস, দ্য স্নোস অব কিলিমাঞ্জারো;

৫. ও. হেনরি (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)– “দ্য গিফট অব দ্য ম্যাজাই, দ্য লাস্ট লিফ;

৬. গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস (কলম্বিয়া)- আ ভেরি ওল্ড ম্যান উইথ এনরমাস উইংস, দ্য হ্যান্ডসোমেস্ট ড্রাউন্ড ম্যান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড;

৭. জর্জ অরওয়েল (যুক্তরাজ্য)- শুটিং অ্যান এলিফ্যান্ট, আ হ্যাংয়িং;

৮. ফ্রান্ৎ কাফকা (চেক প্রজাতন্ত্র)- দ্য মেটামরফোসিস (যদিও এটি নভেলা, ছোটগল্পের মতো), আ হাঙ্গার আর্টিস্ট

৯. মোপাসাঁ (ফ্রান্স)- দ্য নেকলেস, দ্য হরলা;

১০. হুমায়ূন আহমেদ – অপেক্ষা, নন্দিত নরকে; সমুদ্র বিলাস, কাঠপেন্সিল, নীল অঞ্জন, দিঘির জলে কার ছায়া, আগুণের পরশমণি, মধ্যরাতের বিয়ে;

ছোটগল্প লিখতে চাইলে নিয়মিত চর্চা করতে হবে। বিভিন্ন লেখকের গল্প পড়তে হবে এবং জীবনের ছোট ছোট মুহূর্তগুলোকে গল্পের উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা শিখতে হবে।

ছোটগল্প লেখার আগে লেখককে যে বিষয়গুলো মানতে হয়-

১. সংক্ষিপ্ততা ও গাঁথুনি :

ছোটগল্পের আকার সাধারণত সীমিত (৫০০-২০০০ শব্দ) হয়, তাই প্রতিটি শব্দ অর্থবহ হতে হবে। পাঠক এক বসাতেই যেন গল্পটি শেষ করতে পারে সেভাবে গাঁথুনিতে আকর্ষণ থাকবে।

অপ্রয়োজনীয় বর্ণনা বা দৃশ্য বাদ দিতে হবে। গল্পের শুরু, মধ্য ও শেষ পরিষ্কার থাকা চাই।

২. শক্তিশালী সূচনা :

ছোটগল্পের প্রথম কয়েক লাইনে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে। সরাসরি গল্পের মূল ঘটনা বা সংঘাতে নিয়ে যান।

৩. স্পষ্ট ঘটনা বা মূলভাব :

গল্পে একটি কেন্দ্রীয় ঘটনা বা বার্তা থাকা উচিত। গল্পটি পড়ার পরও যেন পাঠকের মনে দাগ থেকে যায়। লক্ষ্য রাখতে হবে অনেকগুলো জটিল বা উপপ্লট এড়িয়ে চলার দিকে।

৪. গতিশীল চরিত্র :

অল্প কথায় চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলুন (সংলাপ, আচরণ বা বর্ণনার মাধ্যমে)।

প্রধান চরিত্রের পরিবর্তন বা বিকাশ দেখানো যায় (ঐচ্ছিক)।

৫. সংঘাত ও সমাধান :

গল্পে একটি কেন্দ্রীয় সংঘাত (Conflict) থাকা জরুরি (ব্যক্তির সাথে ব্যক্তি, প্রকৃতি, সমাজ বা নিজস্ব সংকট)। সমাধান বা অপ্রত্যাশিত মোড় (Twist) দিয়ে গল্প সমাপ্ত করা যায়।

৬. দৃশ্য ও পরিবেশ :

অল্প বর্ণনায় ঘটনার সময়, স্থান ও পরিবেশের ইঙ্গিত দিতে হবে। পাঠক যেন মনে চোখে দৃশ্য কল্পনা করতে পারেন।

৭. শক্তিশালী সমাপ্তি :

গল্পের শেষটি স্মরণীয় বা চমকপ্রদ হওয়া উচিত। ইঙ্গিতপূর্ণ হতে হবে। পাঠকের মনে যেন একটি অতৃপ্তি থাকে। পাঠক যেন ভাবে গল্পটি অন্যভাবেও সমাপ্ত হতে পারতো।

৮. ভাষা ও শৈলী:

সরল ও প্রাণবন্ত ভাষার ব্যবহার করতে হবে। অতিরিক্ত রূপক বা জটিলতা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন। ছোট ছোট বাক্যে লিখলে ভালো।

৯. প্রকৃতির প্রতিফলন:

গল্পে জীবনবাস্তবতা, আবেগ বা সামাজিক প্রেক্ষাপট থাকলে তা পাঠককে সংযুক্ত করবে।

১০. পুনর্লিখন ও সম্পাদনা :

প্রথম ড্রাফ্টের পর বারবার পড়ে অপ্রয়োজনীয় অংশ কাটুন। গল্পের ভাষা, বানান ও গতিপ্রবাহ পরীক্ষা করুন। এবং সম্পাদনা শেষ করুন।

ছোটগল্প ককে বলে, ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য ও লেখার কৌশল এরসাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের লেখকদের সেরা ছোট গল্প সম্পর্কে জানলাম। এক এক লেখক এক এক ভাবে ঘটনার বর্ণনা দেন, জীবন, চরিত্র সমাজের চিত্র তুলে ধরেন। প্রতিটি লেখকই অনন্য। তাদের স্বকীয়তা রয়েছে, তাদের বিকাশের সুযোগ দিতে হবে। উৎসাহিত করতে হবে তবেই নতুন নতুন লেখক তৈরি হবে।  সৃষ্টিশীল কাজে নিজের মেধাকে কাজে লাগান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top