মানুষ সৃষ্টির সেরা এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী জীব। মানুষ শব্দটি এসেছে মান+হুঁশ থেকে। যার মান এবং হুঁশ এই দুটোই আছে তাকেই শুধু মানুষ বলা হয় । যার বিবেক, বুদ্ধি, মানবতা অর্থাৎ অপরের ভালোমন্দ বুঝার জ্ঞান আছে তাকে মানুষ বলে। সুতরাং মানুষ হতে হলে আপনার আত্ব সম্মান বোধ থাকতে হবে। ভালো -মন্দ কে আলাদা করার মতো হুঁশ থাকতে হবে। তবেই আপনি মানুষ বলে গন্য হবেন।
মানুষ দুপায়ে চলতে, কথা বলতে, চিন্তা করতে ও জ্ঞান অর্জনে যথেষ্ট পটু, নিজের ও অপরের কথা ভাববার ক্ষমতা যার আছে। যে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে, সেই ধরণের জীবকে মানুষ বলা হয়ে থাকে।
আধুনিক মানুষ হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির হোমিনিনা উপজাতির একমাত্র বিদ্যমান সদস্য। শিম্পাঞ্জি, গরিলা ও বনমানুষের মত মানুষ বানর পরিবারের অন্তর্গত হোমিনিডি গোত্রের একটি শাখা। স্থলচর প্রাণী হিসাবে তাদের বৈশিষ্ট্য হলো স্থির খাড়া অবস্থান এবং দ্বিপদী চলৎশক্তি; অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন এবং ভারী সরঞ্জাম ব্যবহারে সক্ষমতা; অন্যান্য প্রাণির চেয়ে যোগাযোগের ক্ষেত্রে জটিলতর ভাষার ব্যবহার, আকারে বৃহত্তর ও জটিল মস্তিষ্ক এবং খুবই উন্নত ও সংঘবদ্ধ প্রাণী।
একমাত্র মানুষই সরাসরি বৈপরীত্যময় জীবনযাপনে অভ্যস্ত। ভালো-মন্দ, জন্ম-মৃত্যু, সুখ-দুঃখের সম্মিলনে মানুষ বেঁচে থাকে। মানুষের মাঝে যেমন আছে মানবিকতা তেমনি আছে বর্বরতা। অন্যান্য প্রাণীর মাঝে আমরা দেখি- একটি পশু বেশিরভাগ সময় শিকারের উদ্দেশ্য আরেকটি পশুকে হত্যা করে। এর বাইরে জঙ্গলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রেও নিজ প্রজাতির মধ্যেও হত্যাকাণ্ড ঘটায় হিংস্র পশুরা।
প্রাণীরা নিজ প্রজাতির মধ্যে এবং বাইরের প্রজাতির মধ্যেও বিনা কারণে কোনো হত্যাযজ্ঞ চালায় না। কিন্তু পশু না হয়েও মানবিকগুণ সম্পন্ন মানুষ নিজ প্রজাতির মধ্যেই একদম বিনা কারণে অহরহ হত্যাকাণ্ড চালায়, দেখায় সর্বোচ্চ হিংস্রতা। এই হিংস্রতা দিনকে দিন মানুষের এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে; প্রশ্ন জাগে, মানুষ কী আদৌ আর মানুষ আছে? কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের শুধু লোভ আর হিংসা ছাড়া কিছুই থাকে না। তাদের বলাহয় মানুষরূপী জানোয়ার! এ রকম মানুষ্যজীব সমাজে অনেক আছে। বন্যপ্রাণী বা হিংস্র প্রাণীদের স্বভাব মানুষ বা অন্য প্রাণীরা জানে, কিন্ত মানুষের মুখ আর তার বাইরের আবরণ দেখে বোঝা সম্ভব নয় যে, সে মানুষ না মনুষ্যজীব রূপী জানোয়ার?
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কিছু নৃশংসতা দেখতে পাই- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে তোফাজ্জল নামে একজনকে ভালো করে খাইয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষাথীরা। ২০১৯ সালে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে সারা রাত পিটিয়ে হত্যা করেছে বুয়েটেরই অন্য শিক্ষার্থীরা। ছেলে ধরা সন্দেহে প্রকাশ্য দিবালোকে শত মানুষ মিলে ছেলে ধরা সন্দেহে তাসলিমা বেগম রেনুকে পিটিয়ে হত্যা করে। ঝিনাইদহ জেলার এক সংসদ সদস্যকে পরিকল্পিতভাবে কলকাতায় নিয়ে হত্যার পর টুকরো টুকরো করে কেটে বিভিন্ন স্থানে গুম করা হয়।
সকল ধর্মে কিছু কাজকে জঘন্য পাপের সাথে তুলনা করা হয়েছে। কোরআন, বাইবেল, বেদেও এসব স্বভাবকে নিকৃষ্ট নজরে দেখা হয়েছে। এসব স্বভাব যাদের মাঝে আছে তাদেরকে আদৌ মানুষ বলা যাবে না।
অনিয়ন্ত্রিত কামপ্রবৃত্তি। নৈতিকতা না মেনে নারী বা পুরুষের এ ধরনের কামপ্রবৃত্তি তাকে প্রায় পশুর স্তরে নামিয়ে আনে। পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ধর্ষণ, পরকীয়া, ধোঁকাবাজি, বিকৃত যৌনাচার, বিপরীত লিঙ্গকে অসম্মান, এমনকি হত্যাও- এসবের পেছনে সবচেয়ে বেশি রয়েছে মানুষের অনিয়ন্ত্রিত কামপ্রবৃত্তি। শহরে-গ্রামে, ধনী-গরীব সবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
অনিয়ন্ত্রিত আহার। মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের বহুল আকারে খাদ্য সঞ্চয়ের প্রবৃত্তি আছে। বাঘ বা সিংহ শিকার শেষে ততটুকুই আহার করে যতটুকু তাদের প্রয়োজন। কিন্তু মানুষ জ্ঞানত প্রয়োজনের থেকেও বেশি খায়। সারা বিশ্বে প্রতিবছর কয়েক কোটি টন খাদ্য অপচয় হয়। অন্যদিকে কয়েক কোটি মানুষ বেঁচে আছে একবেলা খেয়ে বা অভুক্ত থেকে। অনিয়ন্ত্রিত আহারের জন্য মানুষের মধ্যে মানবিকতা বোধ লোপ পাচ্ছে, বৃদ্ধি পেয়েছে অসমতা।
লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। অধিকাংশ মানুষের মাঝে লোভ বিদ্যমান। সরকারের ক্ষমতার লোভ, সরকারি চাকরিজীবীর টাকার লোভ, অফিসের কর্তাদের পদোন্নতির লোভ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ছাত্র, সরকারী বেসরকারী কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, ছাত্র, শ্রমিক সবার মাঝেই লোভ মহামারী হিসাবে দেখা যাচ্ছে। যার যত রয়েছে তার তত দরকার। হাজার হাজার কোটি টাকা এক একজনের ব্যাংক একাউন্টে রয়েছে। কয়েক প্রজন্ম খেয়েও তা শেষ করতে পারবে না। তারপরও সে চায়। এ চাওয়ার শেষ নেই। যে যেভাবে পারছে, সে সেভাবে ঠকিয়ে কামাচ্চে। কারণ- লোভ। যা মানুষের মনুষত্ব ও হিতাহিত জ্ঞান কেড়ে নেয়।
আছে হতাশা, ঘৃণা ও হিংসাকে। মানুষ যখন হতাশ হয়ে পড়ে তখন সে নিজের মানবীয় গুণাবলির প্রতি অজ্ঞতা প্রদর্শন শুরু করে। আত্মহত্যা করে, অন্যদের উপর আক্রমণ করে, নেশায় আসক্ত হয়। অন্যদিকে মানুষ হয়ে মানুষকে ঘৃণা করা বা নিজের থেকে উঁচু পর্যায়ে আছে ভেবে কাউকে হিংসা করার প্রবৃত্তিও মানুষকে বর্বর করে তোলে। মধ্যবিত্তের মাঝে এ তিন স্বভাব সচরাচর চোখে পড়ে।
পৃথিবীর বড় বড় পতনের পেছনে একমাত্র চাবিকাঠি ছিল মিথ্যা অহংবোধ। এই অহংবোধ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। মানুষ তখনই আরেকটি মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করে, নিজেকে ঐ মানুষের থেকে উচ্চস্থানে মনে করে। রিকশাচালক, শ্রমিক, বাসার দারোয়ান বা ডমেস্টিক হেলপারকে তুই বলে সম্বোধন করা। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনেও দেখা যায় বিগত ফ্যাসীবাদী সরকার কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি তাদের পতন এতো তাড়াতাড়ি হবে।
আমাদেরকে উপরোক্ত পাপ থেকে বেঁচে থাকতে হবে। অজ্ঞতা ও বিবেকহীনতায় মানুষ মানুষকে মারছে, দেশে দেশ যুদ্ধ বাধাচ্ছে, জাতি গোষ্ঠী ধ্বংস করছে। গাজায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি মারা যাচ্ছেন, ইউরোপে চলছে যুদ্ধ, আফ্রিকায় গৃহযুদ্ধ আর এশিয়ায় রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা পড়ছে প্রতিদিন কেউ না কেউ। মানুষই মানুষকে মারছে। প্রশ্ন জাগে মনে, মানুষ কবে মানুষ হবে? মানুষের মতো মানুষ হবে।
এই মানুষের মত মানুষ বলতে কি বোঝায়? যে সৎ, সংবেদনশীল, অনুভূতিপ্রবণ, মানবিকতা বোধে সমৃদ্ধ, লিঙ্গ সমতায় বিশ্বাসী, নির্ভরযোগ্য এবং দায়িত্ববান মানুষকে। যিনি অন্য মানুষকে মানুষ বলে ভাবেন এবং নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। যিনি সব সময় সত্য কথা বলেন, মানুষের উপকার করার চেষ্টা করেন। আর উপকার যদি নাও করতে পারেন, কারও ক্ষতি করেন না।
পৃথিবীতে কিছু মানুষ আছে যারা সামনে হাসি মুখে থাকবে, কিন্তু পেছনে ছুরি ঢোকাতেও দ্বিধা করবে না। মানুষের সুন্দর চেহারার চেয়ে সুন্দর চরিত্র থাকাই উত্তম। দর্শনদারী নয় গুণেই আসল পরিচয়। সমাজের চাপে, নিয়মের বেড়াজালে আমরা হারিয়ে ফেলি আমাদের সত্যিকারের রূপ। তাই আমরা আসল পরিচয় ঢেকে রেখে মুখোশধারী মানুষ হয়ে সামনে এগিয়ে চলি কোনো অজানা গন্তব্যের দিকে।
এজন্য আগে নিজেকে জানতে হবে। মানুষের বিবেকের চেয়ে বড় আদালত, বড় সত্য আর নেই। স্বার্থের জন্য আমরা নিজেকে চিনতে চাই না। বর্তমান যুগে মানুষের কার্যকলাপ দেখে খোদ মানুষের মনেই প্রশ্ন জাগে, আদৌ মানুষ নিজেকে চিনতে পেরেছে? কিংবা চেনার ন্যূনতম চেষ্টা কি করেছে? আদৌ মানুষ কি তার বিবেককে কাজে লাগাচ্ছে? লাগালেও সেটা কি সবসময়? নাকি নিজের সুবিধা সাপেক্ষে?
অধিকাংশ মানুষই ধর্মের বেড়াজালে আবদ্ধ। ধার্মিক কখনোই সম্পুর্ন মানুষ নয়, অনেক সময় মানুষই নয়। প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহিম খাঁ বলেন “ মানুষের জন্য যা কল্যাণকর তাহাই ধর্ম। যে ধর্ম পালন করতে গিয়া মানুষের অকল্যাণ করিতে হয়, তাহা র্ধমের কুসংস্কার মাত্র। মানুষের জন্য ধর্ম। ধর্মের জন্য মানুষ নয়।“ আমাদেরকে মানবিক মানুষ হতে হবে।
মানুষ নিজের ভুলগুলো কখনই তুলে ধরতে চায় না। অথচ অন্যের ভুলে সামান্যতম ছাড় দেয় না। মানুষ যেদিন অন্যের ভুল ধরার চেয়ে আগে নিজের ভুল ধরতে শিখবে সেদিন মানুষ প্রকৃত মানুষ হবে। উদার, সহানুভূতিশীল, নিষ্কপট, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হবে। সুগুণাবলি তার চরিত্র, আচরণ ও মানসিকতায় প্রতিফলিত হবে।
পরিশেষে মানুষ হবে সৎ ও ঈমানদার, যার সহানুভূতি ও মমত্ববোধ থাকবে। অন্যকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করবে, আত্মসমালোচনা ও আত্ম উন্নতি করবে, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর সাহস রাখবে, সদাচারী ও বিনয়ী হবে, সংকটে শান্ত ও স্থির থাকবে, আত্মনির্ভরশীল ও আত্মবিশ্বাসী হবে, স্বাধীন চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম হবে, সর্বোপরি মানবিক বোধ সম্পন্ন হবে।