জ্ঞান ও জ্ঞানী : কামরান চৌধুরী

ইন্দ্রিয় অনুভূতির নির্ভুল ধারনাই জ্ঞান।  ইন্দ্রিয়পথে আসা উপাদানসমূহের নির্যাস হল জ্ঞানের প্রকাশ। কোন কিছুর সম্পর্কে তাত্ত্বিক বা ব্যবহারিক ধারনাকে জ্ঞান বলে। অর্থাৎ কোনো বিষয়ে জানা, তার প্রকৃত অবস্থা, তথ্য, বিবরণ বা গুনাবলী সম্পর্কে জ্ঞাত থাকা, এবংসেই বিষয়ে নিজের চিন্তা ও ভাবনার মাধ্যমে বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা হচ্ছে জ্ঞান।

জ্ঞান ব্যতীত কর্ম অর্থহীন এবং কাজ ব্যতীত জ্ঞান অর্থহীন। কনফুসিয়াস বলেন- আপনি কি জানেন, আর কি জানেন না, তা জানাটাই হলো সত্যিকারের জ্ঞান । আলবার্ট আইনস্টাইন বলেন জ্ঞান অর্জনের একমাত্র উৎস হলো অভিজ্ঞতা।  সক্রেটিস এর মতে আপনি কিছুই জানেন না, এটা বুঝতে পারাটাই হলো সত্যিকারের জ্ঞান ।

জ্ঞান শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Knowledge, যার অর্থ হলো জানা। কোনো বস্তু সম্পর্কে আমাদের সুস্পষ্ট ও নির্ভরযোগ্য ধারণাই জ্ঞান। হাদিসে আছে জ্ঞান অন্বেষণ করা প্রত্যেক মুসলমান নর ও নারীর উপর ফরজ । জ্ঞান গন্তব্যহীন একটি পথ। যখন থেকে কেউ বুঝতে শুরু করে যে, জগতে এমন জিনিসের সংখ্যাই বেশি যা সম্পর্কে সে কিছুই জানে না, তখন থেকেই জ্ঞানের পথে তার হাঁটা শুরু হয়। জ্ঞানার্জনের আকাঙ্ক্ষা এক পীড়াদায়ক তৃষ্ণা। এ তৃষ্ণা মানুষকে অতৃপ্ত করে রাখে।

জ্ঞানই শক্তি। জ্ঞান ব্যক্তিসত্তাকে পরিশুদ্ধ করে, চিত্তের চাওয়া-পাওয়া নিয়ন্ত্রণ করে, সংযত করে। জ্ঞানের উদয় ব্যক্তির অন্তরলোকে। জ্ঞান দেহ ও মনকে আলোকিত করে। জ্ঞানের ধারক হলো জ্ঞানী, যার উদ্ভাবন ক্ষমতা আছে, সৃজনশীল ক্ষমতা আছে এবং সমস্যার সমাধান দেয়ার যোগ্যতা আছে। আর এ সকল ক্ষমতা যার নাই তাকে জ্ঞানী বলা যায়না।

জ্ঞান অর্জিত হয় উপলব্ধির মাধ্যমে, অনুসন্ধান বা শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে। জ্ঞানের তিনটি স্তর শেখা, জানা ও বোঝা। শেখা, জানা ও বোঝা সমার্থক নয় । যা শেখা হয় তা-ই শিক্ষা । যা জানা হয়েছে তা-ই বিদ্যা বা জ্ঞান । আর এই শেখা ও জানা থেকে যা বোঝা গিয়েছে তা-ই বোধ । এই বোধ থেকেই আপনি আপনার চারধারে ঘটে যাওয়া বিষয়াবলী উপলব্ধি করে অভিজ্ঞতালব্ধ হন; আর এটাই হলো পূর্ণ জ্ঞান যা প্রজ্ঞায় পরিনত হয়। জ্ঞান তাৎপর্যমন্ডিত হয়ে প্রজ্ঞায় রূপান্তর না পেলে বন্ধ্যাই থেকে যায়। উপলব্ধির স্তরে উন্নীত না হলে জ্ঞান মাত্রই বন্ধ্যা। জ্ঞান অর্জনে জটিল মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া জড়িত। উপলব্ধি, সংযোগ এবং যুক্তি, যেখানে জ্ঞানকে মানব মস্তিষ্কের কোনো কিছু বুঝতে পারার ক্ষমতার সাথেও তুলনা করা হয়।

বিদ্যালয়ে আমরা অক্ষরজ্ঞান শিখি, অক্ষর সাজিয়ে বাক্য গড়ি। শিক্ষা বা জানা আমাদের কুশলী করে, আমাদের নৈপুণ্য বাড়ায়, চেতনার প্রসার ঘটায় আর বাড়ায় বিদ্যা-বুদ্ধি। আমাদের এই “জানা” যদি অভিজ্ঞতার আলোকে বোধের আওতায় এসে জীবনের প্রয়োগিক ক্ষেত্রে সফলতার সাথে প্রযুক্ত হওয়ার উপযোগী হয় তবেই তাকে বলতে হয় “জ্ঞান । আর যিনি তা বোঝেন ও এর প্রয়োগও করেন তিনিই তো জ্ঞানী ? বোধশক্তি সবার তীক্ষ্ণ, তীব্র, যুক্তিসঙ্গত নয় । তাই চাই মস্তিষ্কের চর্চ্চা ।

জ্ঞানীরা কেবল সত্যকে আবিষ্কার করতে পারেন, সত্যের রূপ বদলে দেওয়া তাদের কাজ নয়, সেই সক্ষমতাও তাদের নেই। তাই অজ্ঞ ব্যক্তি নিজের অজ্ঞতার ব্যাপারে অজ্ঞ থেকে যেতে পারেন গর্বভরেই, যে গর্ব আসলে মিথ্যা। অজ্ঞতা মানুষকে অতিমাত্রায় রক্ষণশীল ও ভীতু করে রাখে। ফলে সব সময় সুযোগ কাজে লাগানো হয়ে ওঠে না। অনেকের দৃঢ় ধারণা, কিছুই না জানা কারও কারও জীবনও- বেশ নির্বিঘ্ন ও সুখময়। আবার অনেক-জানা কারও কারও জীবন নরকতুল্য। জীবন যাদের নরকতুল্য তাদের জানাশোনার পরিধি ছোট। যারা অল্প জানেন তারা অধিক বলেন, অধিক প্রতিষ্ঠা কামনা করেন। দুঃখের বোধ তখনই বেশি হয় যখন প্রত্যাশা ও অপ্রাপ্তির পার্থক্যটি বিশাল হয়ে দাঁড়ায়। যিনি যত বেশি জানেন, ব্যক্তিজীবনে তিনি তত নির্মোহ থাকতে পারেন। যিনি কিছুই জানেন না, জানতে চানও না, মর্যাদার আকাঙ্ক্ষা তার মনে লুপ্ত হয়ে যায়। মর্যাদার সঙ্গে সুখ শব্দটির এক বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। মর্যাদাবিহীন সুখ অলঙ্কারবিহীন সাজের মতোই আকর্ষণহীন।

নিজ মাটি আর মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ, নির্মোহ-নির্মল জীবন জিজ্ঞাসা , নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গী , বিশ্লেষনের ক্ষমতা, বিচারিক প্রজ্ঞা আর সর্বোপরি বিবেকবোধ আপনাকে সত্যিকারের জ্ঞানী করে তোলে ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top