ধূমপান ছাড়ার উপায় : কামরান চৌধুরী

ধূমপান একটি আসক্তি বা নেশার মতো। এখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা ধূমপান ছেড়ে দেয়ার পণ করেছেন অনেকবার কিন্তু বারবার ব্যর্থ হয়েছেন। তাদের জন্যই এই লেখা, যারা ধূমপান ছাড়তে পারছেন না। পড়ুন, ভাবুন, ব্যবস্থা নিন, অবশ্যই উপকার পাবেন। 

ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও আমরা ধূমপান থেকে বিরত হই না। সিগারেট প্যাকেটে ধূমপানের স্বাস্থ্যক্ষতি দেখেও আমরা বিরত হই না। ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোকসহ অসংখ্য রোগের কারণ এটা। পায়ের নখ থেকে শুরু করে মাথার চুল পর্যন্ত এমন কোনো স্থান নেই যা ধূমপানে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। তারপরও যখন মানুষ ক্রমাগত ধূমপানে অভ্যস্ত হচ্ছে তখন বলতেই হয়- সিগারেট খাবি খা, মারা যাবি যা। 

         দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৩০ হাজারের মতো মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু তামাকজনিত বিভিন্ন রোগে দেশে বছরে এক লাখ ৬১ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। যা করোনার মৃত্যুর চেয়ে ৫ গুণ বেশি।ভ এমনকি তামাক ব্যবহারের চূড়ান্ত পরিণতিতে এক দিনে প্রাণ হারাচ্ছে সাড়ে ৪০০ মানুষ।

তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ যেমন- হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, ক্যানসার ও শ্বাসতন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদী রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের মোট মৃত্যুর ৬৭ শতাংশই অসংক্রামক রোগের কারনে ঘটছে।

আর অসংক্রামক রোগ সৃষ্টির কারণ মূলত ধূমপান ও তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার।

দেশে ৩ কোটি ৭৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহার করে। কার্যক্ষেত্র সহ পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন তি কোটি ৮৪ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। তামাক ব্যবহারে দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ।

তাই হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিন, সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিন। ধূমপান ছেড়ে দেওয়া জাস্ট একটা ডিসিশন। ধূমপান ছাড়ার পর প্রথম তিন-চার মাস সেটি ধরে রাখতে বেশ কষ্ট। এরপর থেকে আর কখনও ধূমপান করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব হয় না। ধূমপান করা এবং না করার মধ্যে শারীরিকভাবে বিরাট পার্থক্য আছে। ছেড়ে দেয়ার পর ঘুম ভালো হয়, ক্ষুধামন্দা ভাব লাগে না। ধূমপায়ীরা ধূমপান ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অটল থাকতে চাইলে নিচের টিপসগুলো মেনে চলতে পারেন। 

১. পরিকল্পনা করুন এখুনি ধূমপান ছাড়বেন। প্রতিজ্ঞা করুন।

২. কেন ধূমপান ছাড়বেন, সেই তালিকা তৈরি করুন। অসংখ্য কারণ পাবেন ধূমপান ছাড়ার। চিন্তা করে নিজের সিদ্ধান্তের পক্ষে একটি শক্ত তালিকা তৈরি করুন। তালিকায় আপনার স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে আপনার আশপাশের মানুষের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর ধূমপানের প্রভাব, আর্থিক অপচয় ইত্যাদি থাকা আবশ্যক। এরপর যখন ধূমপানের ইচ্ছা জাগবে, তখনই এসব কারণ ভাবতে শুরু করবেন। এতে আপনার ধূমপানের প্রতি আগ্রহ কমতে থাকবে।

৩। টেবিল বা পকেটে রাখা সিগারেটের প্যাকেট ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলুন। একদিন ধূমপান না করে দেখুন। এরপর পার্থক্য অনুভব করার চেষ্টা করুন। এরপর দুইদিন , তিনদিন ধূমপান থেকে দূরে থাকুন। তাহলে অভ্যাস গড়ে উঠবে। আত্মবিশ্বাস রাখুন। আগেরবারের ভুলগুলোর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেদিকে সাবধান থাকতে হবে।

৪. দুপুর ও রাতের আহারের পর অনেকেই ধূমপান করতে ভালোবাসেন। গবেষণায় দেখা যায়- মাংসজাতীয় খাবার খাওয়ার পর ধূমপান উপভোগ্য হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ফল কিংবা সবজিজাতীয় খাবারের পর ধূমপান কিছুটা স্বাদ হারায়। তাই মাংস এড়িয়ে খাদ্য তালিকায় শাকসবজি ও ফলমূল রাখুন। আর খাওয়া শেষে এমন স্থানে যান, যেখানে ধূমপানের সুযোগ নেই। অ্যাকোহলমিশ্রিত পানীয়, কোমলপানীয়, চা, কফি ইত্যাদি পানের সময় অনেকে ধূমপান করেন। যা পানীয়র স্বাদ আরও বাড়িয়ে দেয়। তাই এ ধরনের পানীয়র অভ্যাস ছেড়ে প্রচুর ফলের রস ও পানি পান করুন।৩. আপনার আশপাশে যারা ধূমপান বর্জন করেছে তাদের অনুসরণ করুন। তাদের স্বাস্থ্যগত কী পরিবর্তন এসেছে সেটি জানার চেষ্টা করুন।

৫. হিসেবে করুন সিগারেট কিংবা তামাকজাত পণ্যের পিছনে মাসে কত টাকা খরচ হয়? সে টাকা জমিয়ে অন্য খাতে খরচ করতে পারেন।

৬. ব্যস্ততা বাড়ান: দিনের যে সময়ে ধূমপানের ইচ্ছা বেশি জাগে, তা শনাক্ত করুন। এরপর সেই সময়ে নিজেকে কোনো কাজে ব্যস্ত রাখুন, হাঁটাহাঁটি করুন, ব্যায়াম করুন, পরিবারের লোকজনের সঙ্গে আড্ডা দিয়েও নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারেন। ব্যস্ততা বাড়লে ধূমপানের কথা ভুলে থাকা সহজ হবে। ধূমপান কর্নার থেকে দূরে থাকুন।

৭. অধূমপায়ী বন্ধু বাড়ান: ধূমপান ছাড়ার পর প্রথম কয়েক দিন ধূমপায়ী বন্ধুদের সঙ্গে সরাসরি আড্ডা থেকে বিরত থাকুন। একই সঙ্গে অধূমপায়ী বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর চেষ্টা করুন।

৮. সিগারেট ছাড়ার পর মুখ খালি রাখবেন না: মুখ খালি থাকলেই ধূমপানের আগ্রহ জাগবে। মুখে চকলেট, লজেন্স, চুইংগাম বা আদা চিবোতে পারেন। তাহলে ধূমপানের প্রতি আকর্ষণ কমে আসবে।

৯. বড়দের পরামর্শ নিন: ধূমপান ছেড়েছেন, এমন কাউকে চেনা থাকলে তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিন। তাঁর অভিজ্ঞতাগুলোকে কাজে লাগান। ফেসবুকে একাধিক গ্রুপ রয়েছে, যেখানে ধূমপান ছাড়ার ব্যাপারে পরামর্শ ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করা হয়। এসব গ্রুপে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে ইতিবাচক ফল পাওয়া যেতে পারে। ধূমপান বিরোধী এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার বই পড়তে পারেন।

১০. কোনো কিছুতেই আসক্তি কমাতে না পারলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ও কাউন্সেলিং নিতে পারেন।

সবশেষে ধূমপান ছাড়তে শক্তিশালী ব্যক্তিগত যুক্তি দাঁড় করুন।

ধূমপান ছাড়ার আগে অবশ্যই জানতে হবে কেন ধূমপান ছাড়তে চান আপনি। একটি ব্যক্তিগত শক্তিশালী কারণ অবশ্যই খুঁজে বের করুন যা আপনাকে ধূমপান ত্যাগে সাহায্য করবে। হতে পারে সন্তানের জন্য, তারুণ্য ধরে রাখতে, দীর্ঘদিন সুস্থ্য থাকতে, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস হতে মুক্তি পেতে। প্রিয় কোনো ব্যক্তির জন্যও হতে পারে। ভেবে ভেবে একটি শক্তিশালী কারণ দাঁড় করান এবং যা আপনাকে ধূমপান করা থেকে বিরত রাখবে। পণ করার আগে বুকের ভেতর আগুন জ্বালাতে হবে, কেন ছাড়বো? কেন ছাড়বো? তবেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা সহজ হবে।

ডোন্ট স্মোক, ইটস নট এ জোক। ৩১ মে নো টোবাকো ডে। এখন সময় জীবন বাঁচাবার। বন্ধ করুন ধূমপান ও তামাকের ব্যবহার। শুধুমাত্র তামাক সেবনের জন্যই প্রতি বছর সারা বিশ্বে ৮০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। তামাক সেবনের ক্ষতিকারক, মারাত্মক প্রভাব তুলে ধরার জন্যই তামাক বিরোধী দিবস প্রতি বছর ৩১ মে তারিখে বিশ্বজুড়ে পালন করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সদস্য রাষ্ট্রসমূহ ১৯৮৭ সালে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস চালু করে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top