যে ব্যক্তি একটি দল বা গোষ্ঠীর মানুষকে একটি নির্দিষ্ট ফলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশনা দেন, প্রভাবিত করেন তিনি নেতা। একজন নেতার উদ্যোগ, তদারকি, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা কর্মীদের মধ্যে কর্মস্পৃহা জাগ্রত করে এবং কার্য সম্পাদনের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। নেতৃত্ব হচ্ছে বিশেষ কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য অন্যদেরকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাজকে কিংবা তাদের আচরণকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে নিয়ে আসার ক্ষমতাকেই নেতৃত্ব বলা হয়।
মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হচ্ছে নেতৃত্বের আকাঙ্খা। মনের গভীরে আমরা সবাই কম-বেশি নেতৃত্বের আকাঙ্খা লালন করি। অবদান রাখতে চাই পরিবার, কর্মক্ষেত্র, সমাজ কিংবা দেশের জন্য। হয়ে উঠতে চাই অনুকরণীয়, অনুসরণীয়। এজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে প্রয়োজন- সচেতন চিন্তাধারা, নিয়মিত অনুশীলন এবং সাধনা। নিজের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী গড়ে তুলতে সবার আগে ‘আত্মসচেতন’ হতে হবে।
নেতাকে উপকারের উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। অন্যদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দিতে হবে। তাঁর এমন কাজ করা উচিত, যাতে সমাজের মানুষ তাঁকে অনুসরণ করে। প্রভাবিত করার ক্ষমতা থাকতে হবে। তাঁকে বুদ্ধিমান, আত্মবিশ্বাসী, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন হতে হবে। জন্মগতভাবে প্রতিটি মানুষের মধ্যে নেতৃত্ব দেওয়ার সহজাত গুণ রয়েছে। কারও কারও মধ্যে তা সুপ্ত থাকে। নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশ করার জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়। নেতৃত্ব মানেই প্রভুত্ব নয়, সে বোধ নেতার মধ্যে থাকতে হয়।
নেতৃত্ব দেওয়ার গুণ সবার থাকে না। তবে অনেকেই কঠোর পরিশ্রম ও সতর্কতার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে ভালো নেতা হতে পারেন। সঠিক নেতৃত্বের অধিকারী ব্যক্তি পৃথিবীর যে কোনো কাজকে সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারে। যিনি দলের মাঝে নিজের প্রভাব খাটিয়ে দলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। একজন সুদক্ষ ও সুপরিচিত নেতা হিসাবে গড়ে উঠতে কিছু গুণের অধিকারী হতে হয়। সেগুলো হলো-
নির্ভীকভাবে যেকোনো কাজে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতার মধ্যেই প্রকৃত নেতৃত্বর প্রকাশ হয়। কখনো কখনো তাকে গতানুগতিক রাস্তা ছেড়ে অজানা রাস্তায় হাঁটতে হয়। লক্ষ্যে পৌঁছানোই তার মূল লক্ষ্য, তাই সাহসী হতে হয়। নেতাকে শিখতে হয়, দৃষ্টি প্রসারিত করতে হয়। বই পড়ে, চারপাশের পরিবেশ আর মানুষ থেকে শেখার অনেক কিছু আছে। নিজের অভিজ্ঞতার সাথে অন্যের অভিজ্ঞতার মিশ্রণ প্রয়োজন। যত বেশি শিখবে তত ভালোভাবে মানুষ চিনতে পারবে। কথায় আছে রিডার থেকে লিডার।
নেতাকে অনেক মানুষের সাথে কাজ করতে হয়। তারা হতে পারে সহকর্মী, ঊর্ধ্বতন বা অধস্তন কর্মকর্তা। মানুষের আবেগ-অনুভূতি বুঝতে পারা ও সে অনুযায়ী তার সাথে কাজ করা, কারো ভেতরের সুপ্ত ক্ষমতা বুঝতে পারা, আর সে ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর জন্য সাহায্য করা, এগুলো নেতার যোগ্যতাকেই ফুটিয়ে তোলে। সহকর্মীদের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোকে শক্তিতে পরিণত করার উপায় দেখিয়ে দেয়া। ফলে তাদের উদ্যম বেড়ে যায়। সুন্দর ভারসাম্যপূর্ণ দল গড়ে উঠে। নানা বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে আস্থা তৈরি করে নিতে পারে।
একটি ঘটনা বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে। তাই বিভিন্ন দিক থেকে ভাবতে হবে। যেটি সবাই ভাবছে সেটি নাও হতে পারে। যখন একটি ঘটনাকে বিভিন্ন দিক থেকে বিচার করা হয় তখনই আসল কারণ বুঝতে পারা যায়। তাই নেতা হিসেবে গড়ে উঠতে চাইলে সবকিছু ঠান্ডা মাথায় পর্যালোচনা করতে হবে। নেতা ভিন্নভাবে চিন্তা করে ভালো ফলের জন্য নতুন কিছু করার চেষ্টা করেন।
নিজের প্রতি অগাধ বিশ্বাসী হতে হবে। নিজেকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। নির্ধারণ করতে হবে জীবনের লক্ষ্য। ভালো-মন্দ বুঝে নিয়ে লক্ষ্য অর্জনে তৎপর হতে হবে। কারণ, ব্যক্তিভেদে মানুষের জীবনের চাহিদা এবং পরিতৃপ্তির জায়গা ভিন্ন হয়। অন্যকে অনুকরণ করতে গিয়ে স্বকীয়তা হারিয়ে ফেললে- তার সঙ্গে হারিয়ে যেতে পারে আপনার সহজাত নেতৃত্বের শক্তি এবং গুণাগুণ।
একজন নেতাকে উত্তম শ্রোতা হতে হবে। সৎ মতে, সৎ পথে থাকতে হয়। সংক্ষেপে ও স্পষ্টভাবে কথা বলুন। যতটা বলবেন, তার চেয়ে বেশি শোনার চেষ্টা করুন। মানুষ বা অনুসারীরা কী চায় এবং তাদের কী দরকার সে ব্যাপারে ভাল নেতারা মনযোগ দেয়। যেকোন নতুন আইডিয়াকে স্বাগত জানায়।
নিজের দুর্বলতা এবং বিনয় একজন নেতাকে মহান বানায় এবং একটি ইতিবাচক শক্তির সঞ্চার হয়। অনুসারী, কর্মচারী এবং মিডিয়া সবাই চায় একজন শুদ্ধ মনের নেতা সাফল্য লাভ করুক। তাকে আত্মত্যাগী ও নিঃস্বার্থ বাদী হতে হবে। নেতাকে সৎ ও আত্মসচেতন হতে হবে। সৎ ও দক্ষ নেতৃত্বের গুণে কুসংস্কার ও সামাজিক অনাচারকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারে সমাজ।
নেতা তার চরিত্র দিয়ে তার দলের সঙ্গীদের ও অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এছাড়া সমাজও একজন নেতার চরিত্র দেখেই তার সম্বন্ধে নতুন ধারণা তৈরি করে।
নেতার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং কর্মপন্থা কর্মীদের কাছে স্পষ্ট রাখাটা নেতাদের অন্যতম আদর্শ হওয়া উচিত। কোন কিছু লুকিয়ে রেখে লাভ নেই, যারা রাখেন, তাদের মুখোশ এক সময়ে উন্মোচিত হয়ে যায়। সরলতা এবং সততা আপনার কর্মচারী, গ্রাহক আর সহকর্মীদেরকে খুশি রাখবে।
অন্যদের সাহায্য করা, উদ্ভাবনী আইডিয়াকে গুরুত্ব দেওয়া, বিনয়ী হওয়া এবং দলগত ভাবে কাজ করার নিয়ম মেনে চললে সবার পছন্দের নেতায় পরিণত হওয়া যায়।
নেতাকে কঠোর পরিশ্রমী ও অপরিসীম ধৈর্যের অধিকারী হতে হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে কাজ করে সেই কাজ থেকে যদি কোন ইতিবাচক পরিবর্তন না ঘটে তবুও তিনি ধৈর্য হারান না। দিনের পর দিন কাজ করে যান এবং পরিশ্রম করেন যতদিন পর্যন্ত সফল হতে পারছেন না।
সমাজ পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীলতার সুযোগ ও চ্যালেঞ্জের ব্যাপারে নেতাদেরকে নমনীয় হতে হবে এবং সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করার ক্ষমতা থাকতে হবে।
স্টিভ জবস বলেন “যখন আপনি আপনার কাজকে ভালবাসবেন, তখনই আপনি ভাল কাজ করতে পারবেন”। যারা তাদের কাজকে ভালবাসে, তাদের কাছে প্রতিদিনকার কাজকে আর বোঝা মনে হয় না। যারা নিজেদের কাজের মধ্যে ভালবাসা নিয়ে আসতে পারে তাদের একটি সুবিধা রয়েছে, তাদের এই ভালবাসা তাদের গ্রাহক এবং সহকর্মীদের মাঝেও ছড়িয়ে যায়। কাজের প্রতি আগ্রহী ও দায়িত্বশীল হতে হবে।
নেতারা ছোট ছোট ওয়াদা করে কিন্তু সে অনুযায়ী বেশি বেশি দিয়ে থাকে, যাতে গ্রাহক এবং কর্মচারীরা ইতিবাচকভাবে চমকিত হতে পারে। বাড়তি টাকা খরচ না করে চমক দেওয়ার অনেক উপায় রয়েছে- যেমন একটি সুন্দর হাসি, সম্মান দিয়ে কথা বলা। চমক এবং আনন্দের বিষয়গুলো কিন্তু আপনার প্রতিষ্ঠানের নাম সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে দিতে পারে।
নেতারা তাদের কাজে ও সাফল্যে যাদের অবদান আছে তাদের প্রতি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকে। অন্যের তারিফ করে এবং মেন্টর, গ্রাহক, সহকর্মী ও অন্য স্টেকহোল্ডারদের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার মাধ্যমে নেতাদের বিনয় ফুটে উঠে এবং অন্যরাও ভাল চোখে দেখে থাকে।
সমস্যা সমাধানে বা তাৎক্ষনিক পরিস্থিতিকে মোকাবেলায় উপস্থিত বুদ্ধি থাকতে হবে। মানুষের মাঝে সামাজিক সচেতন বোধ বৃদ্ধি করতে হবে। চোখ-কান খোলা রেখে চারপাশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কাজ করলে আশাতীত ফল এনে দিতে পারে।
নেতাকে দক্ষ ও অভিজ্ঞ হতে হবে। তাকে সংগঠনের জনবলকে পরিচালনা করার ক্ষমতা থাকতে হবে। নেতাকে তার পেশাগত জ্ঞান সম্পন্ন হতে হবে। নেতার অন্যতম ধর্ম হলো সাহস, ভয় ভীতি এমনকি সর্ব প্রকার প্রতিবন্ধকতা দুর করার ক্ষমতা থাকতে হয়। তাকে তীক্ষè ও সু² কৌশলী হতে হয়।
নেতৃত্ব কেউ এমনিতেই হাতে পায় না, এটা অর্জন করতে হয়। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হয়-গণসংযোগের মতো। বিশ্বস্ততা বজায় রাখা। বিশ্বাস তৈরির ক্ষেত্রে সময়ানুবর্তিতা অত্যন্ত দরকারি।
বিভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করে ন্যায় বিচার করার ক্ষমতা থাকতে হবে। নেতাকে বিবেকবান হতে হয়। দেশপ্রেম, বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী, পোষাকে মার্জিত ও রুচিশীল এবং বিনয়ী হতে হবে। সহকর্মীদের প্রতি উদার হতে হবে। তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা থাকতে হবে।
নেতাকে কোনো স্থানে, দলে কাজ করতে হয়। তাই সবার আগে সেই দল ও দলের সদস্যদের সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। এ থেকেই তাদের প্রত্যেককে নিয়ে ধারণা করতে পারেন নেতারা।
আদর্শ নেতা নিজের চিন্তাধারা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেন এবং অন্যদেরটাও গ্রহণ করেন। সৃজনশীলতাকেও উৎসাহ দেন।
নেতা সর্বদা বিনয়ী এবং ভদ্র হয়। একজন নেতা হওয়ার জন্য সর্বপ্রথম অন্যের প্রিয় ব্যক্তি হতে হবে। সেজন্য সবচেয়ে বড় দরকারি গুণাগুণ হলো নম্র এবং ভদ্র হওয়া।
আদর্শ নেতারা যেকোনো বিষয়ের ইতিবাচক বিষয়গুলো তুলে আনতে সক্ষম। তারা নিয়মিত বাধাগুলোকে টপকে যেতে পারেন। নেতিবাচক বিষয়গুলো দক্ষতার সঙ্গে মানিয়ে নেন।
দলের সদস্যরাই নেতাকে সহায়তা করতে পারেন। নেতার শুভাকাঙ্খী, পরামর্শদাতা এবং পেশাদার ফেলো থাকবে। তারা নেতাকে বিভিন্ন জটিল পরিস্থিতিতে সুপরামর্শ দিয়ে পরিচালিত করবেন।
নেতা সবসময় চেষ্টা করে কীভাবে নিজেকে আরো ভালোভাবে গড়ে তোলা যায়, কীভাবে নতুন কিছু জানা যায়, কীভাবে নতুন কোন সুযোগ বের করা যায়, কীভাবে কোন কিছুকে আরো সহজবোধ্য করে তোলা যায়। বিষয়গুলো চর্চা করলে অনেক কিছুই আস্তে আস্তে আয়ত্বে আসে। আপনাকেও সমাজের বিভিন্ন স্তরে নেতার ভুমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে তাই এই গুণগুলো অর্জনের চেষ্টা করুন। সফলতা আপনার কাছে ধরা দিবেই।