শান্তি এবং ধৈর্যের প্রতীক হিসাবে কচ্ছপকে বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন জীব কচ্ছপ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং আমাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপনে সহায়তা করে। এই কচ্ছপ সম্পর্কে মানুষকে অবগত করতে এবং প্রকৃতির অন্যান্য জীবের পাশাপাশি এই জীবের প্রতি সম্মান দেখানো ও এর সম্পর্কে জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য ২০০০ সালে ‘অ্যামেরিকান টরটয়েজ রেসকিউ’ নামক প্রতিষ্ঠান এই কচ্ছপ দিবস এর সূচনা করেন।
সেই থেকেই দিবসটি ২৩ মে সারাবিশ্বে বিশ্ব কচ্ছপ দিবস উদযাপিত হচ্ছে। ধরিত্রীর সবচেয়ে প্রাচীন জীব কচ্ছপ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা, কচ্ছপ সম্পর্কে জ্ঞান বৃদ্ধি, কচ্ছপের বিলুপ্ত আবাসস্থলগুলিকে রক্ষা করতে এবং সেই সাথে তাদের বেঁচে থাকতে এবং উন্নতি করতে সহায়তা করার জন্য মানুষের কাজকে উৎসাহিত করতে সহায়তা করে এই দিবস।
কচ্ছপ জলস্থল উভয় স্থানেই বাস করে। শক্ত খোলস দ্বারা আবৃত প্রাণীটি প্রাচীন প্রাণীদের মাঝে অন্যতম। কচ্ছপ ৭০ থেকে ৮০ বছর এমনকি ১৫০ বছর বেঁচে থাকে। বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ প্রজাতির কচ্ছপ রয়েছে বলে জানা যায়। আর বাংলাদেশে রয়েছে ২০ প্রজাতির কচ্ছপ। এর মধ্যে কিছু প্রজাতি মারাত্মকভাবে বিলুপ্তির পথে। এক সময় বঙ্গোপসাগর, নদীনালা, বিল-বাওড়, পুকুরসহ বাড়ির আঙিনাতেই কচ্ছপ দেখা যেত। এখন আর তেমন দেখাই যায় না। দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) সামুদ্রিক কচ্ছপ সংকটাপন্নের পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছে।
১. জেলেদের মাছ ধরার সময় জালে আটকা পড়ে প্রচুর সংখ্যক কচ্ছপ মারা যায়। জালে জড়িয়ে, আবাসস্থল ধ্বংস ও খাদ্যশৃঙ্খলে পরিবর্তনের কারণেও মারা যায়।
২. সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম খাওয়ার জন্য অনেকে সংগ্রহ করে। আবার কচ্ছপ ও কাছিমকে খাদ্য হিসেবেও খায়। তা ছাড়াও এদের থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করা হয়।
৩. উপকূলের উন্নয়নের নামে অনেক দেশেই কচ্ছপের আবাস ধ্বংস করা হচ্ছে। ডিম পাড়ার জন্য সংরক্ষিত স্থানে পর্যটকদের আনাগোনাও কচ্ছপ সংকটের একটি বড় কারণ। এ ছাড়াও জাহাজ চলাচল, সমুদ্রের তলদেশের পরিবর্তনসহ নানাবিধ কারণ রয়েছে।
৪. প্লাস্টিক, পরিত্যক্ত মাছ ধরার যন্ত্রপাতি, তেল বর্জ্য এবং অন্যান্য পদার্থ খেয়ে কিংবা পরিত্যক্ত জালের সঙ্গে জড়িয়েও মারা যায়। রাসায়নিক দূষণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। উপকূলে আলোর ঝলকানি ডিম পাড়ায় বাধা দেয়।
৫. আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন এদের বাসস্থানের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে। এছাড়া পুকুর জলাশয়ে বিষ ও কীটনাশকের ব্যবহার, জমিতে সার প্রয়োগ, কচ্ছপের প্রয়োজনীয়তা না জানা, প্রাণী দেখামাত্রই মেরে ফেলা ইত্যাদি কারণে এরা সংকটাপন্ন হচ্ছে।
কচ্ছপ- সরীসৃপ শ্রেণির অন্তর্গত প্রাণী। এরা মাংসাশী ও তৃণভোজী উভচর জাতীয় প্রাণী। সবচেয়ে বড় কচ্ছপ সমুদ্রে বাস করে এবং দ্বৈত আকৃতির কাছিম দ্বীপ শুষ্ক (arid) পরিবেশে বাস করে। বেশির ভাগ কচ্ছপেরা কাছাকাছি বাস করে তবে বক্স কচ্ছপ বনাঞ্চলের খোলাস্থানে বাস করে। স্থলজ কাছিম (tortoises) শুষ্ক পরিবেশে বাস করে। ছোট কচ্ছপ (turtles) খাদ্য হিসেবে জলজ অমেরুদন্ডী প্রাণী গ্রহণ করে। স্থলজ কচ্ছপ, সামুদ্রিক কাছিম আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে উদ্ভিজ খেয়ে থাকে।
কচ্ছপের অনেক প্রজাতি পানিতে বা পানির আশেপাশে বাস করলেও এরা ডাঙায় ডিম ছাড়ে। কচ্ছপ সাধারণত রাতে ডিম পাড়ে। মাটিতে গর্ত করে একটি মেয়ে কচ্ছপ ১ থেকে ৩০টি পর্যন্ত ডিম পাড়তে পারে। ডিম পাড়ার পর কচ্ছপ ডিমগুলোকে মাটি বালি বা অন্য যেকোনো জৈব পদার্থ দিয়ে ঢেকে দেয়। মূলত ডিম পাড়ার পর কচ্ছপ ডিমগুলোকে প্রকৃতির দায়িত্বেই রেখে চলে যায়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে প্রজাতিভেদে ৬০ থেকে ১২০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে।
মানুষের খাদ্য হিসাবে কচ্ছপের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে গিয়েছিল, তাই অতিরিক্ত আহরণ ও পরিবেশের বিপর্যয়ের দরুণ বাংলাদেশে কচ্ছপের জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির সম্মুখীন। তাছাড়াও এরা রপ্তানী পণ্য ছিল, বিধায় এর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পেয়েছে। কচ্ছপের বাসস্থানের বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা ও আহরণ বন্ধ করতে না পারলে শীঘ্রই এদের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে পড়বে।
বর্তমানে বাংলাদেশে কচ্ছপ ধরা, মারা, শিকার, বিক্রি, বিপণন, স্থানান্তর, চাষ, পাচার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। বাংলাদেশের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে কচ্ছপ ধরা, মারা, শিকার, বিক্রি, বিপণন, স্থানান্তর, চাষ, পাচার করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
কচ্ছপ মানব সমাজে বিভিন্ন রকম উপকার করে থাকে। এরা সর্বভুক প্রাণী, এরা জলাভূমিতে, নদীনালায় মরা, পচা-গলা, ময়লা জিনিস খেয়ে জলকে পরিষ্কার রাখে এবং জল দূষণ রোধ করে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে এবং আমাদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে সহায়তা করে । বিভিন্ন প্রকার পোকামাকড় এবং মশার ডিম ও লার্ভা খেয়ে এদের বংশ নিয়ন্ত্রণ করে এবং বিভিন্ন রোগের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করে। কচ্ছপ ও কাছিম যেসব স্থানে বসবাস করে, ডিম পাড়ে, সেই সব স্থানের বাস্তুতন্তের ভারসাম্য বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা যে কোন জলভাগের তীরবর্তী অংশের উদ্ভিদ জগতকে বেড়ে উঠতে ও পুষ্টি জোগানে সাহায্য করে।
এই প্রাণিরা জলভাগের অবাঞ্ছিত ঘাস, উদ্ভিদ খেয়ে এদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে, না হলে এগুলি মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে যাবে এবং জলের বস্তুতন্ত্রের উপরে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। যেমন সবুজ কচ্ছপ, যারা সামুদ্রিক ঘাস খেয়ে বেঁচে থাকে।
লেদার – ব্যাক কচ্ছপেরা প্রচুর পরিমাণে জেলিফিশ খেয়ে বেঁচে থাকে, এই জেলিফিশগুলি সাধারনত মাছের লার্ভা খেয়ে নেয়। ফলে এই কচ্ছপেরা জলের খাদ্য শৃঙ্খল রক্ষা করে।
কৃত্রিম আলো কচ্ছপের অভ্যন্তরীণ বিচরণ ব্যবস্থাকে বিশৃঙ্খল করে স্ত্রী কচ্ছপদের বাসা বাঁধতে নিরুৎসাহিত এবং সমুদ্রে দিকে যাওয়ার চেষ্টারত বাচ্চাদের বিভ্রান্ত করে। প্লাস্টিকের ছোট টুকরো থেকে তৈরি সিগারেটের গোড়া পেটে জমা হয়ে হজমে সমস্যা তৈরি করে না খেয়ে কচ্ছপের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
সমুদ্রে প্রতিটি প্রাণী অন্য প্রাণীর ওপর নির্ভরশীল। ছোট মাছ ফাইটো-প্লাংকটন নামে এক ক্ষুদ্র কণা খায়। ছোট মাছকে খায় একটু বড় আকৃতির মাছ। বড় আকৃতির মাছকে তার চেয়ে বড় আকারের কোনো প্রাণী খেয়ে বেঁচে থাকে। এই পরস্পর নির্ভরশীলতাকে বলে বাস্তুতন্ত্র। একে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখতে সামুদ্রিক কচ্ছপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা সামুদ্রিক ঘাস ও স্পঞ্জ খায়। ফলে ঘাস ও স্পঞ্জ খুব বেড়ে যায় না। পানির প্রবাহ ঠিক থাকে। অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণীর বৃদ্ধিতেও সাহায্য করে। কচ্ছপ জেলিফিশ ও ক্রাস্টাসিয়ানও খায়। ফলে এগুলোর সংখ্যা নিয়ন্ত্রিত থাকে, এমনকি এরা অন্যান্য মাছের জন্য খাদ্য সরবরাহ করে। কারণ, ছোট ছোট প্রাণী কচ্ছপের খোলের সঙ্গে লেগে থাকে, যেগুলোকে ছোট মাছ খুঁটে খুঁটে খায়।
এমন এক উপকারী বন্ধুকে আমরা আমাদের লালসা মেটাতে প্রতিদিন হত্যা করে নিজেদের খাদ্য বানাই। মানব সভ্যতার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে এদের প্রাকৃতিক পরিবেশে এই কাছিম ও কচ্ছপের অস্তিত্ব বজায় রাখতে হবে। এদের রক্ষা করা আমাদের মানবিক ও সামাজিক কর্তব্য।