নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া নারীকে স্বপ্নের পথে হাটতে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। নারীর অন্তর্নিহিত শক্তিকে স্বীকৃতি দিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখতেন নারীরা একদিন শিক্ষা ও বিজ্ঞানের আলোয় উন্মুক্ত হবে। পুরুষের মতো নারীও সমাজের সকল কাজে অংশ নিবে। মেধা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নারীরা তাদের যোগ্য সম্মান খুঁজে নিবে। বাঙালি মুসলিম শিক্ষায় পথিকৃৎ হিসেবে রোকেয়া নারীদের শিক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করেন। তাঁর লেখা সুলতানার স্বপ্ন হয়ে ওঠে সমগ্র মুসলিম নারীর কন্ঠস্বর।
১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে এক অভিজাত পরিবারে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম এবং ১৯৩২ সালের এই দিনেই মাত্র ৫২ বছর বয়সে কলকাতায় তার মৃত্যু হয়েছিল। পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের শিক্ষিত জমিদার ছিলেন। তার মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। দুই বোন করিমুননেসা ও হুমায়রা, আর ভাই মোহাম্মদ ইব্রাহীম আবুল আসাদ সাবের ও খলিলুর রহমান আবু যায়গাম সাবের ছিলেন বিদ্যানুরাগী। তার পিতা আরবি, উর্দু, ফারসি, বাংলা, হিন্দি এবং ইংরেজি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন তবুও মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে ছিলেন রক্ষণশীল। আধুনিকমনস্ক ভাই ও বিদ্যোৎসাহী ও সাহিত্যানুরাগী বোনের সাহচার্যে বেগম রোকেয়ার শিক্ষালাভ, সাহিত্যচর্চা এবং সামগ্রিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে।
বাঙালি মুসলিম নারী স্বাধীনতার পক্ষে প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষার প্রসারে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নব জাগরণের মশাল জ্বালিয়েছেন। স্বীয় পরিবারে ইংরেজি শিক্ষার বিরোধী হলেও বড় ভাইয়ের মতো আধুনিকমনস্ক মানুষের সংস্পর্শে আসতে পেরে তার জ্ঞান তৃষ্ণাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।
আজ থেকে একশ বছরেরও বেশি সময় আগে বেগম রোকেয়া যে সাহসিকতা, উদার মনোভাব দেখিয়েছেন তা আজও নারীদের অগ্রযাত্রায় অনুসরণীয়, অনুকরণীয়। কঠোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা অপসংস্কৃতির আর নারীবিদ্বেষী নিয়মের বেড়াজালে বন্দি ছিল।সেসময় নারীরা সন্তান জন্মদান, লালন পালন ও গৃহকর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরিবারে মতামত প্রকাশ করতে পারতো না, বাইরে সহজে বের হতে পারতো না। পড়াশুনা করতে পারতো না, সামাজিক নানা কুসংস্কার সমাজে আষ্টেপিষ্টে ছিল। নারীরা যে কেবল ভোগের সামগ্রী নয় সে কথা তার রচনার মধ্যে দিয়ে তিনি বুঝিয়ে গেছেন। বেগম রোকেয়া তার চিন্তা চেতনা, তার ধ্যান-ধারণায় তখনকার নারীদের চেয়ে ছিলেন অনেক অনেক এগিয়ে। এমনকি এই আজ আধুনিক যুগে দাঁড়িয়েও অনেক নারী যখন তার অধিকারের কথা বলতে দ্বিধা করে তখন তিনি তার কর্ম দিয়ে দৃঢ় চেতনার পরিচয় দিয়েছেন।
ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, বিজ্ঞান কল্পকাহিনি ও শ্লেষাত্মক রচনায় রোকেয়ার স্টাইল ছিল স্বকীয় বৈশিষ্ট্যম-িত। উদ্ভাবনা, যুক্তিবাদিতা এবং কৌতুকপ্রিয়তা তার রচনার সহজাত বৈশিষ্ট্য। তার প্রবন্ধের বিষয় ছিল ব্যাপক ও বিস্তৃত। বিজ্ঞান সম্পর্কেও তার অনুসন্ধিৎসার পরিচয় পাওয়া যায় বিভিন্ন সাহিত্যকর্মে আর আলোচনায়।
‘পিপাসা’ শিরোনামে মহররম বিষয়ক প্রবন্ধ দিয়েই ১৯০২ সালে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সাহিত্যচর্চার শুরু । অন্যদিকে ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর রাতে মৃত্যুর আগে অসমাপ্ত লেখা ‘নারীর অধিকার’—প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে সাহিত্যচর্চার শেষ হয়েছে। ১৯০৮ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত তার সাহিত্য কর্ম বন্ধ ছিল। তিন দশকে বেগম রোকেয়ার পাঁচটি বই লিখেছেন- মতিচূর (১ম ও ২য় খন্ড), সুলতানার স্বপ্ন, পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী। ১৯৭৩ সালে বাংলা একাডেমি পাঁচটি বই এর সাথে অগ্রন্থিত ২৫টি প্রবন্ধ, ৭টি ছোটগল্প, ১২ টি কবিতা, ইংরেজি ভাষায় ২ টি প্রবন্ধ ও ২২টি চিঠি নিয়ে বেগম রোকেয়া রচনাবলি প্রকাশ করেন।
নিরন্তর পাঠক বেগম রোকেয়া বাংলা, ইংরেজি, ফারসি, উর্দু—সব রকম সাহিত্য, বিজ্ঞান, কৃষি, পুষ্টি, চিকিৎসার বই, প্রবন্ধ, সাময়িকী ও সংবাদপত্র থেকে তিনি পাঠের আনন্দ, জ্ঞান অর্জন, নারীমুক্তির যুক্তি-চর্চা পরিশীলিত করেছেন।
বেগম রোকেয়ার অবরোধ বাসিনীর প্রতিটি ঘটনাই তৎকালীন নারীদের সামাজিক অবস্থান, কঠোর পর্দা প্রথা, অশিক্ষা, কুসংস্কার, পুরুষতান্ত্রিকতা নির্মমতা প্রভৃতি বর্ণিত হয়েছে। ভীষণ প্রতিকূল পরিবেশে তিনি নারী শিক্ষার আলো প্রজ্বলন করেন। অবরোধ বাসিনী একটি হাস্যরসাত্মক রচনা যার মাঝে তিনি পর্দাপ্রথার নামে তৎকালীন সমাজের সমস্ত অনিয়ম তুলে ধরেছেন সুচারুরূপে। বইটিতে নারীদের ৪৭টি বাস্তব কাহিনি বা সত্য ঘটনা বিধৃত হয়েছে। যার মাঝে নারীদের লাঞ্চনার কথা বর্ণিত হয়েছে।পর্দাপ্রথার নামে ধর্মীয় কুসংষ্কারগুলোতে কুঠারাঘাতই ছিলো অবরোধবাসিনীর মূল লক্ষ্য।
সমসাময়িক সামাজিক-সাংস্কৃতিক কূপমণ্ডূকতা, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য যে ধর্মশিক্ষা, সততা, জ্ঞান ও সাহস অর্জন করেছিলেন রোকেয়া, তাঁর লেখনীতে এর প্রকাশ রয়েছে। তিনি নারীর সমানাধিকার নিয়ে ক্রমাগত প্রবন্ধ, উপন্যাস তথা সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে নারীর বঞ্চনাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। তাঁর সাহিত্য সাধনা ও লেখালেখির মূল বিষয় ছিল সমাজের গলদ তুলে ধরা, নারীর প্রকৃত শক্তির উদ্ঘাটন করা ও নারীকে অধিকারসচেতন করে তোলা। নারীসমাজের প্রতি সব বৈষম্য ও শোষণ বন্ধের জন্য যে কলম তুলে নিয়েছিলেন, তাঁর রচনাসমূহের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল, আর এটিই লেখক হিসেবে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনকে অনন্য করে তুলেছে। তার ক্ষুরধার লেখনীতে অসাম্প্রদায়িকতার চেতনার মনোভাব ফুটে উঠেছে। ভারতীয় নারীর দুঃখ দুর্দশা লিখতে যেয়ে হিন্দু মুসলমান উভয় নারীদের দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন। পদ্মরাগ উপন্যাসে সিদ্দিকা ও সৌদামিনীর নিগ্রহের কাহিনি দরদ দিয়ে তুলে ধরেছেন। তারিনী ভবনে শুধু যে নানা জাতি, নানা ধর্ম এবং নানা শ্রেণীর মানুষ তাই নয় সেখানে কি সুন্দর সাম্য। মুসলমান, হিন্দু, ব্রাক্ষ্ম খ্রিস্টান সকলে যেন এক মাতৃগর্ভজাত সহোদরার ন্যায় মিশেমিশে কাজ করিতেছে।
স্বপ্ন দেখান একজন, সে স্বপ্ন হাজার চোখে স্বপ্ন হয়ে ঘুরতে ঘুরতে কোনো এক সময় তা বাস্তবে রূপ নেয়। ‘সুলতানার স্বপ্ন’বেগম রোকেয়ার এক অনন্য সৃষ্টি। নারীবাদী সাহিত্যে, নারী চেতনার জাগরণে এটি অনন্য রচনা। এই উপন্যাসে সমাজে পুরুষ কর্তৃত্বের বিষয়টি খণ্ডন করতে গিয়ে তিনি পুরুষদের অকর্মণ্য, অলস, মূল্যবোধহীন, বলে বেশি ও করে কম, মোটা বুদ্ধি, নারীর মেধা ও মূল্য বুঝতে অক্ষম এবং শান্তির সহজ উপায় থাকলেও যুদ্ধ বাঁধিয়ে প্রাণ ও সম্পদ ক্ষয়কারী-এই ৭ ভাগে ভাগ করেছেন।
মতিচুর প্রবন্ধ গ্রন্থে রোকেয়া নারী-পুরুষের সমকক্ষতার যুক্তি দিয়ে নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনের তুলে ধরে নারী-পুরুষকে সমাজ উন্নয়নে আসার আহ্বান করেছেন। এখানে নারীদের পিছিয়ে থাকার প্রধান কারণ হিসাবে নারীশিক্ষার অভাবকে চিহ্নিত করেছেন। নারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন, ভোটাধিকারের জন্য লড়াইটা শুরু করেছিলেন বেগম রোকেয়া। তিনি লেখেন মেয়েদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে, যাতে তারা ভবিষ্যৎ জীবনে আদর্শ গৃহিণী, আদর্শ জননী এবং আদর্শ নারীরূপে পরিচিত হতে পারে। তিনি নারী ও পুরুষকে একটি গাড়ির দুটি চাকার সাথে তুলনা করেছেন। কেননা একটি চাকা ছাড়া পুরো গাড়িটাই অচল। তাই নারী ও পুরুষ যদি মিলেমিশে কাজ করে, তাহলে সমাজে পরিবর্তন আসবেই। সমাজের অর্ধেক অংশকে বাদ দিলে কখনোই রাষ্ট্রের উন্নতি হবে না।
বই আকারে প্রকাশের পূর্বে তার লেখাগুলো নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তুলেছেন। তার রচনা সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি, ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করেছে।
তার রচনাতেই প্রকাশ হয়েছে ধর্মীয় বিধানের অপব্যবহারের কথা, সে যুগের নারীদের শারীরিক মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক অবরুদ্ধতার কথা। তিনি বলেছেন সমাজ উন্নয়নে নারী ও পুরুষের যৌথ অবদানের গুরুত্ব। কিছু রচনায় আবার ফুটে উঠেছে নারী ও পুরুষের সম্পর্ক ও তার বিভিন্ন মাত্রিকতার বিশ্লেষণে তার গভীর অন্তদৃষ্টি সংস্কারমুক্ত আধুনিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। সমকালীন রাজনীতির প্রসঙ্গও স্থান পেয়েছে তার লেখায়। মুক্তচিন্তা, ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ও শানিত লেখনীর মাধ্যমে তিনি বিংশ শতাব্দীর অনন্য ব্যক্তিত্বে পরীণত হয়েছেন।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাঙালি চিন্তাবিদ, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক। তিনি বাঙালি মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত। ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী ও শ্লেষাত্মক রচনায় রোকেয়া অনন্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। উদ্ভাবনা, যুক্তিবাদিতা এবং কৌতুকপ্রিয়তা তার রচনার সহজাত বৈশিষ্ট্য। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে বিবিসি বাংলার ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ জরিপে ষষ্ঠ নির্বাচিত হয়েছিলেন বেগম রোকেয়া। রোকেয়ার কর্ম ও আদর্শ উদ্যাপনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছর ৯ই ডিসেম্বর রোকেয়া দিবস উদ্যাপন করে এবং বিশিষ্ট নারীদের অনন্য অর্জনের জন্য বেগম রোকেয়া পদক প্রদান করে।