প্রাকৃতিক রত্ন লজ্জাবতী গাছ (Mimosa pudica) অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও উপকারী ভেষজ উদ্ভিদ। এটি লাজুক লতা বা স্পর্শকাতর গাছ নামেও পরিচিত। এর পাতাগুলো স্পর্শ করলে বা কোনো ঝাঁকুনি পেলে তা মুড়িয়ে যায় ও নিচের দিকে ঝুকে পড়ে। লজ্জাবতী গাছ দেখতে ছোট, গাছে গোলাপি, বেগুনি বা সাদা রঙের ফুল হয়। শুধু সৌন্দর্যেই নয়, এই গাছের রয়েছে অসাধারণ ভেষজ গুণ। প্রাচীনকাল থেকে আয়ুর্বেদ, ইউনানি ও লোকজ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
লজ্জাবতী গাছের পরিচয়
লজ্জাবতী গাছ মূলত মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলে জন্মে। এটি বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে মাঠে, বনে, পতিত জমিতে বেড়ে ওঠে।
গাছটি ক্ষুদ্রাকার ও বহুবর্ষজীবী, এর উচ্চতা সাধারণত ১-২ ফুট ।
গাছটির কাণ্ড কাঁটাযুক্ত, পাতাগুলো যৌগিক, পালকের মতো বিন্যাসে সাজানো।
পাতা স্পর্শ করলে মুড়িয়ে যায়। পাতার প্রতিটি অংশে স্পর্শকাতর কোষ থাকে। যা বাইরের যেকোনো সংবেদনশীলতা যেমন স্পর্শ, কম্পন বা আলো-অন্ধকারের প্রতিক্রিয়ায় সঙ্কুচিত হয়।
ফুল ছোট, গোলাপি, বেগুনি ও সাদা রঙের এবং গোলাকার মাথায় ফোটে।
ছোট ছোট ফল হয়, ফলগুলি শুঁটি আকারের এবং বীজে ভরা থাকে।
লজ্জাবতী গাছের ভেষজ গুণ ও উপকারিতা
লজ্জাবতী গাছের মূল, পাতা, কাণ্ড, ফুল ও বীজ সবই ঔষধিগুণে ভরপুর। এতে অ্যান্টিসেপটিক, অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিফাঙ্গাল, অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ডায়ুরেটিক গুণ রয়েছে। লজ্জাবতী গাছের ভেষজ গুণ ও উপকারিতা রয়েছে তা তুলে ধরা হলো-
১. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে
লজ্জাবতী গাছের পাতার রস বা নির্যাস রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে। এটি ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায় এবং গ্লুকোজ বিপাক উন্নত করে। লজ্জাবতী পাতার রস খালি পেটে সকালে এক চা চামচ পরিমাণে খেতে পারেন। শুকনো পাতার গুঁড়ো চায়ের সাথে মিশিয়েও পান করা যায়।
২. রক্তপাত বন্ধ, ক্ষত ও ঘা নিরাময় করে
লজ্জাবতী গাছের অ্যান্টিসেপটিক ও অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ রয়েছে। এটি দ্রুত রক্তপাত বন্ধ করে, ক্ষত, কাটা স্থান বা ফোঁড়া সারাতে সাহায্য করে। পাতা ও মূল বেটে পেস্ট তৈরি করে ক্ষতস্থানে লাগালে রক্তপাত বন্ধ হয় এবং সংক্রমণ রোধ করে। এটি পোড়া জায়গায়ও ব্যবহার করা যেতে পারে।
৩. হজমশক্তি বৃদ্ধি ও পেটের সমস্যা দূর করে
লজ্জাবতী গাছের মূল ও পাতার রস পেটের গ্যাস, অ্যাসিডিটি, বদহজম ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। এটি পাচনতন্ত্রের সংক্রমণও কমায়। পাতার রস বা মূলের ক্বাথ (জলীয় নির্যাস) তৈরি করে পান করুন। পাতার গুঁড়ো গরম পানির সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
৪. ব্যথা ও প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে
লজ্জাবতী গাছের অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি গুণ রয়েছে, যা বাতের ব্যথা, মাথাব্যথা ও পেশী ব্যথা কমাতে কার্যকর। পাতার পেস্ট গরম করে ব্যথার স্থানে লাগালে আরাম মেলে। মূলের নির্যাস জয়েন্টের ব্যথা কমাতে ব্যবহার করা হয়।
৫. মানসিক চাপ ও অনিদ্রা দূর করে
লজ্জাবতী গাছের শিকড় ও পাতায় উপস্থিত অ্যালকালয়েড স্নায়ু শান্ত করে। এটি অনিদ্রা দূর ও মানসিক উদ্বেগ কমাতেও কার্যকর। পাতার রস বা চা রাতে শোয়ার আগে পান করলে ঘুম ভালো হয়।
৬. ত্বকের সমস্যা দূর করে
একজিমা, ব্রণ, ফুসকুড়ি ও চুলকানি দূর করতে লজ্জাবতী গাছের পাতার পেস্ট খুব উপকারী। এটি ত্বকের সংক্রমণও রোধ করে ও ঘা শুকাতে সাহায্য করে। পাতার পেস্ট ত্বকে লাগিয়ে শুকিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
৭. রক্ত পরিষ্কার করে ও লিভার সুস্থ রাখে
লজ্জাবতী গাছের ডিটক্সিফাইং গুণ রয়েছে। এটি রক্ত পরিষ্কার করে এবং লিভারের কার্যকারিতা উন্নত করে। পাতার রস বা চা নিয়মিত পান করুন।
৮. উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
এই গাছের রস রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়।
৯. প্রাকৃতিক কৃমিনাশক
লজ্জাবতী গাছের মূল ও পাতার রস কৃমি দূর করতে সাহায্য করে। এটি শিশুদের কৃমি সংক্রমণ প্রতিরোধেও কার্যকর।
১০. জন্ডিস ও লিভার সমস্যা নিরাময়ে সহায়ক
লজ্জাবতী গাছের পাতা ও শিকড় লিভারকে পরিষ্কার করে। যকৃতের কার্যকারিতাও বাড়াতে সাহায্য করে। এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান লিভারকে সুরক্ষা দেয়।
১১. মহিলাদের স্বাস্থ্য সমস্যায় উপকারী
মাসিকের ব্যথা, অনিয়মিত পিরিয়ড ও লিউকোরিয়া (সাদাস্রাব) দূর করতে এটি কার্যকরী। প্রসূতির পর জরায়ু সঙ্কোচনের জন্য লজ্জাবতী গাছের মূল ও পাতা ব্যবহৃত হয়। এটি জরায়ুর দুর্বলতা দূর করে এবং অতিরিক্ত রক্তপাত রোধ করে।
১২. বিষাক্ত দংশনে ও সাপে কাটা জায়গায় উপযোগী
সাপ, পোকা-মাকড় বা বিষাক্ত প্রাণীর কামড়ে লজ্জাবতী গাছের পাতা বেটে আক্রান্ত স্থানে লাগালে বিষক্রিয়া হ্রাস পায়। পাশাপাশি এতে ফোলা বা ব্যথা কমে যায়।
১৩. মূত্র সংক্রান্ত সমস্যা নিরাময়ে কার্যকর
লজ্জাবতী একটি প্রাকৃতিক ডায়ুরেটিক। এটি প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, প্রস্রাবের সংক্রমণ বা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন (UTI)-এর চিকিৎসায় কার্যকর। পাতার রস খেলে প্রস্রাব পরিষ্কার হয় এবং যন্ত্রণা কমে।
১৪. পাইলস বা অর্শ রোগে উপকারী
আয়ুর্বেদ অনুসারে, লজ্জাবতী গাছের মূল গুঁড়ো করে সকালে খালি পেটে খেতে হয়। সামান্য গরম দুধ বা পানি দিয়ে খেলে অর্শ বা পাইলসের সমস্যায় উপকার পাওয়া যায়। এটি রক্তক্ষরণ বন্ধ করে এবং মলদ্বারের প্রদাহ কমায়।
সাদা লজ্জাবতী গাছের শিকড়ের উপকারিতা

সাদা লজ্জাবতী গাছের শিকড় ঐতিহ্যগতভাবে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে রয়েছে: শিকড় বেটে বা সিদ্ধ করে খেলে ডায়রিয়া, আমাশয় ও পেটের ইনফেকশন কমাতে সাহায্য করতে পারে। জয়েন্ট বা মাংসপেশির ব্যথা কমানোর জন্য শিকড়ের রস বা পেস্ট ব্যবহার করা হয়। রক্তের বিষক্রিয়া ও ত্বকের সমস্যা (যেমন একজিমা) কমাতে সহায়ক। মূত্রথলির ইনফেকশন ও প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া কমাতেও সাহায্য করে। শিকড়ের রস পেটের কৃমি দমনে কার্যকরী ভূমিকা রাখে।
লজ্জাবতী গাছের ব্যবহারের সতর্কতা
যদিও লজ্জাবতী গাছের ভেষজ গুণ ও উপকারিতা অনেক আছে। তবে কিছু সতর্কতা মেনে চলা প্রয়োজন: বিশেষ করে গর্ভবতী মহিলাদের এটি এড়িয়ে চলা উচিত। কারণ এটি গর্ভাশয় সংকোচন ঘটাতে পারে। অতিরিক্ত সেবনে বমি বা ডায়রিয়া হতে পারে। দুর্বলতা বা লো ব্লাড প্রেসার দেখা দিতে পারে। । যেকোনো ভেষজ ব্যবহারের আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
উপসংহার
লজ্জাবতী গাছ প্রকৃতির এক আশ্চর্য ভেষজ উপাদান। সহজলভ্য এই উদ্ভিদটি নানা রকম রোগ প্রতিরোধে ও নিরাময়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। আধুনিক যুগে প্রাকৃতিক ওষুধের প্রতি যে আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে লজ্জাবতী গাছ তার স্থান আরও সুদৃঢ়ভাবে করে নিচ্ছে। এর সঠিক ব্যবহার জানলে এটি একটি প্রাকৃতিক ওষুধ হিসেবে কাজ করে। তবে এর ব্যবহারের সময় সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। এই গাছটি শুধু আমাদের স্বাস্থ্যই নয়, পরিবেশের জন্যও উপকারী, কারণ এটি মাটির উর্বরতা বাড়ায়। তাই লজ্জাবতী গাছের গুরুত্ব অনুধাবন করে এর সংরক্ষণ ও ব্যবহার বৃদ্ধি করা উচিত।