পরিবারের বাইরে আমাদের আরেক পরিবার হলো কর্মক্ষেত্র। যাদের সাথে কাজ করি তারাই আমাদের অন্যতম আপনজন। কেননা দিনের একটি বড় অংশ সহকর্মীদের সঙ্গেই কাটাতে হয়। এমনও হয়, দিনে যত ঘণ্টা আমরা বাড়িতে কাটাই, তার চেয়ে বেশি সময় আমরা অফিসে ব্যয় করি। সে কারণেই অফিসে যাঁরা আমাদের সহকর্মী, তাঁদের সঙ্গে আমাদের একধরনের হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কাজের পাশাপাশি নানান কথা, হাসি, আড্ডা, গল্পের স্মৃতি, ব্যক্তিগত জীবনের টুকিটাকি কথা, পরনিন্দা, পরচর্চা, সাংসারিক জীবনের আলোচনা ইত্যাদি চলতে থাকে তাদের সঙ্গে। এতে কাজের একঘেয়েমিতা কমে। সহকর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কাজের পরিবেশকে সহজ করে তোলে, কাজে মনোযোগ ও দক্ষতা বাড়ে।
পরিবার ও বন্ধুদের মতোই সহকর্মীদের গুরুত্বও আমাদের জীবনে অপরিসীম। দীর্ঘসময় একসঙ্গে কাজ করতে করতে ফর্মাল সম্পর্কের মোড়ক ভেঙে বন্ধুত্ব হওয়াটাও স্বাভাবিক। তবে সব সহকর্মীদের সঙ্গে একরকম সম্পর্ক হয় না। কারও সঙ্গে মানসিকভাবে কাছাকাছি হলেই তখন তার সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনার ইচ্ছে জাগে। অফিসে সবার সঙ্গে সব বিষয়ে আলোচনা করা মোটেও ঠিক নয়। কেউ আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হতেই পারেন। তার সঙ্গে আপনি সাংসারিক বিষয় আলোচনা করতেই পারেন। কিন্তু অযথা পারিবারিক সমস্যা, স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া, শাশুড়ির সঙ্গে মনোমালিন্য, স্ত্রীর সঙ্গে সমস্যা বা শ্বশুরবাড়ির কথা, প্রেম-ভালোলাগা, পরকীয়া সম্পর্ক এসব বিষয় গণ আলোচনায় না আনাই ভালো।
নিজের সব কথা সহকর্মীদের সঙ্গে বলা জরুরি নয়, উচিতও নয়। কিছু কথা না বলাই উত্তম। চলুন জেনে নেওয়া যাক যে কথা গুলো কখনোই তাদের কাছে না বলাই উত্তম-
১। নিজের ব্যক্তিগত বিষয়গুলো সহকর্মীর সঙ্গে শেয়ার না করাই ভালো। যদি আপনি সবই তাদের শেয়ার করতে থাকেন তাহলে আপনার দুর্বলতা সম্পর্কে তারা জেনে যাবে, যেটা তাদের গসিপের বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই সবকিছু সহকর্মীদের বলা ঠিক না।
২. ব্যক্তিগত আর্থিক তথ্য- আপনার আর্থিক পরিস্থিতি গোপন রাখুন, সহকর্মীদের সঙ্গে এটি নিয়ে আলোচনা করবেন না। আপনার বেতন, ঋণ বা বিনিয়োগ অনেক সময় অফিসে অপ্রয়োজনীয় চাপ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা তৈরি করতে পারে। তারা আপনার জীবনযাপন বা অর্থ পরিচালনা করার ক্ষমতা সম্পর্কে সঠিকভাবে না জেনেই মন্তব্য করতে পারে, এটি অন্যদের প্রভাবিত করতে পারে। এ তথ্য গোপন থাকলে পেশাদার স্থান বজায় থাকে এবং অর্থের সঙ্গে জড়িত কোনো ভুল বোঝাবুঝি বা দ্বন্দ্ব প্রতিরোধ করা যায়।
৩. কর্মক্ষেত্রে রাজনীতি বা ধর্ম নিয়ে কথা বলা ঠিক নয়। আপনি যা বিশ্বাস করেন তা আন্তরিকভাবে বিবেচনা করতে পারেন। সহকর্মীরা বিভিন্ন মতামত রাখতে পারে এবং এটি তাদের মধ্যে বাক-বিতণ্ডার কারণ হতে পারে। যদি আপনার কর্মক্ষেত্রকে শান্তিপূর্ণ এবং সংহত হিসাবে বজায় রাখতে চান, তাহলে সেখানে এ ধরনের আলোচনা করা এড়িয়ে চলুন। পেশাদার হোন, কাজের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে ফোকাস করুন। অফিসে ব্যক্তিগত মতামত ও বিশ্বাস নিয়ে চর্চা না করাই শ্রেয়।
৪. সহকর্মীদের বা ম্যানেজমেন্টের বিরুদ্ধে বাজে কথা বলা বা গসিপ করা কাজের সম্পর্ককে বিষাক্ত করতে পারে। হয়তো সেগুলোর সমালোচনা করা সঠিক, কিন্তু এটি আপনার নেতৃত্বের ওপর আস্থা রাখার বিষয়ে সমস্যা তৈরি করতে পারে।
৫. যতক্ষণ না অফিসিয়াল ঘোষণা করতে প্রস্তুত হন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার ভবিষ্যত কাজের পরিকল্পনাগুলো গোপন রাখা ভালো। কোম্পানী ত্যাগ করার বা অন্য সুযোগ খোঁজার আপনার উদ্দেশ্য শেয়ার করা অনিশ্চয়তা তৈরি করতে পারে এবং আপনার বর্তমান ভূমিকাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। আপনার চাকরির পরিকল্পনা ব্যক্তিগত রাখলে তা কর্মজীবনের গতিপথ নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
৬। একান্ত ব্যক্তিগত কথা না বলা- সহকর্মীদের সঙ্গে হৃদ্যতা বজায় রাখতে যদি মন উজাড় করে সব কথাই বলে ফেলেন, তাহলে কিছু ঝামেলাও হতে পারে। চাণক্য বলেছিলেন, অতিরিক্ত সব কিছুই বিষ। এমনকি ভালো জিনিসের বাড়াবাড়িও ভালো নয়। অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপচারিতার ব্যাপারটাও সে রকম। তাঁদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে, সহৃদয়ভাবে কথা বলতে হবে ঠিকই, কিন্তু কত দূর কী বলবেন, সে ব্যাপারে খানিকটা সতর্ক থাকা পেশাগত উন্নতি ও মানসিক শান্তি—দুটিই জন্যই জরুরি। সহকর্মীরা আমাদের বন্ধুর মতো, কিন্তু পুরোপুরি বন্ধু নন—কথাটা সব সময় মনে রাখা ভালো। কাজের ক্ষেত্রে সহকর্মীরা সহযোগিতা যেমন করেন, তেমনি প্রতিযোগিতাও করেন। সুতরাং পরিস্থিতি পাল্টে গেলে সহকর্মীর অবস্থান ও আচরণ পাল্টাতে পারে। সহকর্মীর কাছে ভরসা করে এমন কোনো মনের কথা বলা উচিত নয়, যা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি সবার সামনে বলে ফেললে আপনি বিব্রত হতে পারেন। একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলো শুধুমাত্র কাছের বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করাই ভালো।
৭। টিমওয়ার্কের ক্ষেত্রে সরাসরি কাউকে নেতিবাচক কথা বলা ঠিক না। এতে সে আপনার ওপর বিরক্ত হবে। পরবর্তী সময়ে আপনার কাজে সহযোগিতা করবে না। তাই কাজের ক্ষেত্রে চাপে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। তাই সহকর্মীকে নেতিবাচক কথা বলা থেকে বিরত থাকা উচিত। – সহকর্মীর স্যালারি নিয়ে প্রশ্ন করবেন না: ‘আপনি কত স্যালারি পান’- এই প্রশ্ন করাটা শুধু অপ্রাসঙ্গিকই নয়, বরং বেকামিও বটে।
-ধার চাইবেন না: অনেকে দেখা যায় অফিসে ২/১ দিন ম্যানিব্যাগ বা টাকা আনতে ভুলে যান। এটা স্বাভাবিক বিষয়, এমনটা হতেই পারে। সেক্ষেত্রে শুভাকাঙ্ক্ষী বা ভালো সম্পর্কের সহকর্মীদের থেকে টাকা ধার নিয়ে খরচ করাটা স্বাভাবিক হতে পারে। কিন্তু আপনি যদি এটাকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেন, তাহলে ভবিষ্যতে সহকর্মীরা আপনাকে এড়িয়ে যাবেই।
– গুজব রটাবেন না। অন্য সহকর্মী সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করবেন না। কারো সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু দেখলে সরাসরি তার সঙ্গেই বিষয়টি নিয়ে আলাপ করুন।
– নারী সহকর্মীকে টাইট পোশাকে সুন্দর দেখাচ্ছে বলবেন না: প্রশংসা করা আইনের পরিপন্থী নয়। কিন্তু আপনি কী বিষয়ে প্রশংসা করছেন তা বিবেচনার বিষয়। সহকর্মীদের শারীরিক বিষয়ে প্রশংসা করা পেশাগত কোনো কাজ নয়, বরং অনেকক্ষেত্রে সেটা খারাপ এমনকি যৌন হয়রানির মতোও মনে হতে পারে।
সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলব ঠিকই। কথা বলার জন্য অনেক অনেক ভালো বিষয় রয়েছে। কাজের বিষয়ে কথা বলতে পারেন, দক্ষতা বাড়ানোর নানা উপায় নিয়ে কথা বলতে পারেন। কাজের বাইরে নিজেদের নানা আগ্রহের বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারেন। সহকর্মীদের কারও কোনো ভালো কাজ বা আচরণ দেখলে তাঁর প্রশংসা করতে পারেন, মোটিভেশন দিতে পারেন। এসব আলোচনা থেকে অনেক সময় দারুণ সব আলোচনা পরিকল্পনা শুরু হয়।