ধূমপান তথা সিগারেট, বিড়ি, চুরুট বা তামাক, জর্দা, গুল ইত্যাদি। ধূমপানে বিষপান। বাইরে থেকে আমরা দেখি দুই আঙ্গুলে ধরা একটি সাদা শলাকা জ্বলছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে মানুষটি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে এই সিগারেটের কারণেই। শুধু ধূমপানের কারণেই মানুষের আয়ুষ্কাল কমে যায় ১০-২০ বছর। প্রতি বছর ১ কোটি লোক ধূমপানের কারণে অসুস্থ হয় এবং ৮২ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়। এটি প্রতিরোধ যোগ্য অকাল মৃত্যুর প্রধান কারণ। সিগারেটের একটা টানে তিন হাজারেরও অধিক রকম রাসায়নিক পদার্থ ঢুকে যায় ধূমপায়ীর শরীরে। এর মধ্যে প্রধান হলো নিকোটিন। এই নিকোটিনই ধূমপান ছাড়তে দেয় না।
শরীরের এমন কোনো অঙ্গ নেই যে ধূমপানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। চলুন জেনে নিই ধূমপান শরীরের কি কি ক্ষতি করে-
-ধূমপানের কারণে ক্যান্সার হয়। সিগারেট-বিড়িতে ৬৫ রকমের বেশি ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পদার্থ থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৩ শতাংশের ক্যান্সারের কারণ ধূমপান। ধূমপানের ফলে সবচেয়ে বেশি হয় ফুসফুসের ক্যান্সার। প্রতি বছর বিশ্বে ১৩ লাখ লোক মারা যায় ফুসফুসের ক্যান্সারে। অধূমপায়ীদের চেয়ে ধূমপায়ীদের ফুসফুসে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা দশগুণ। ঠোট, মুখ, জিহ্বা, গলা, খাদ্যনালী, অগ্নাশয়, গলবিল, কিডনি, মুত্রথলি, বৃহদান্ত্র ও মলাশয়, স্তন, জরায়ু মুখ ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কয়েকগুণ বেশি।
-ধূমপানের ফলে রক্তনালীতে প্লাক জমার ফলে হৃৎপিন্ডের পেশী ঠিকভাবে অক্সিজেন পায় না। ফলে হার্ট অকেজো বা হার্ট এ্যাটাক হতে পারে ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ায়।
-ধূমপান ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। এটি প্রদাহ, ইনসুলিন প্রতিরোধ এবং চাপ সৃষ্টি করে, গ্লুকোজ বিপাক ব্যাহত করে। নিকোটিন ইনসুলিন সংবেদনশীলতা কমিয়ে দেয়, রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়। তামাকের টক্সিন ইনসুলিন উৎপাদন কমিয়ে দেয়। ধূমপান পেটে চর্বি জমতে সাহায্য করে, সেইসঙ্গে কার্ডিওভাসকুলার ঝুঁকি বাড়ায়, ডায়াবেটিসও বাড়িয়ে তোলে।
-ধূমপান ডিম্বাশয়ের জন্য ক্ষতিকর এবং বন্ধ্যত্বের অন্যতম কারণ। পুরুষের শুক্রাণুর সংখ্যা ও মান কমে যায়। নারীদের গর্ভবতী হওয়াকে কঠিন করে, ভ্রুণ ও নবজাতক শিশুর স্বাস্থ্যকেও প্রভাবিত করে। গর্ভবতী মা ধূমপান করলে বা পরোক্ষ ধূমপানের স্বীকার হলে কম ওজনবিশিষ্ট শিশুর জন্ম হতে পারে। শিশু গর্ভাবস্থায় বা জন্মের পরে তামাকের সংস্পর্শে আসলে তার আচরণগত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
– ধূমপান দাঁত এবং মাড়ির স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে। নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ, দাগযুক্ত দাঁত, মাড়ির রোগ, দাঁতের চিকিৎসাকে দীর্ঘায়িত করে, মুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়, লালা উৎপাদন হ্রাস করে ও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি করে।
-ধূমপান ছানি পড়ার ঝুঁকি বাড়ায়, তামাকের ধোঁয়ায় থাকা বিষাক্ত রাসায়নিকগুলো চোখের সূক্ষ্ম টিস্যুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা দৃষ্টিশক্তির অবনতি এবং অন্ধত্বের দিকে নিয়ে যায়।
– অন্ত্রের স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিকোটিন পাকস্থলীর প্রতিরক্ষামূলক আবরণকে হ্রাস করে। ফলে অ্যাসিডের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় ও সরাসরি খাদ্যনালীতে যায়, যা অস্বস্তির কারণ হয়। এটি ভিটামিন সি এবং ই-এর মতো মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট শোষণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এগুলোর ঘাটতিতে মানুষ দ্রুত দুর্বল এবং বিষণ্ণ হয়ে পড়ে।
– ধূমপায়ীরা ইনফ্লুয়েঞ্জাতে আক্রান্ত হয় বেশি এবং রোগের তীব্রতাও অনেক বেশি, বিশেষ করে বৃদ্ধদের।
– ধূমপানের ফলে শ্বসনতন্ত্রের গাঠনিক পরিবর্তন ও ইমিউন সিস্টেমের পরিবর্তন ঘটে ফলে সংক্রমণের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়।
– অধূমপায়ীর তুলনায় ধূমপায়ীর যৌন অক্ষমতায় ভুগার হার ৮৫ শতাংশ বেশি
– রক্তচাপ ও হার্টবিট বাড়ায়, মাথা ঝিমঝিম, মানসিক চাপ তৈরি করে।
-মস্তিষ্কের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। স্মৃতিশক্তি ও বোধশক্তি দুটিই কমে যেতে পারে। আলঝাইমার্স রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ডিমেনশিয়া হতে পারে, মস্তিষ্ক ছোট হতে পারে মপানে ।
– লিভার এনজাইম লেভেল বাড়ায় যার ফলে ওষুধের কার্যকারিতা কমে আসে।
-হজমশক্তি কমে, ক্ষুধা কমে, লিপিডের ভাঙন ত্বরান্বিত করে এবং ওজন কমায়।
-ধূমপানের ফলে অস্থি ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে এবং অস্ত্রোপচারের পর ক্ষত নিরাময়ে বিলম্ব ও জটিলতা দেখা দেয়।
– ইন্দ্রিয় ক্ষমতা ঘ্রাণ নেয়া এবং স্বাদ গ্রহণ ক্ষমতা লোপ পায়।
– ধূমপায়ীদের শ্রবণশক্তি কমে যায়।
– ধূমপানে মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পযন্ত ক্ষতি। ত্বকেরও ক্ষতি।
সবশেষে ধূমপান হ’ল অপচয়। ধূমপান অপমৃত্যু, ধূমপানে মনোবল দুর্বল, ধূমপানে নিজের পরিবারের, সমাজের ও দেশের ক্ষতি। ক্ষতি ছাড়া ধূমপানে কোনো উপকার নেই। তাই আজই ধূমপান ছাড়ুন। জীবন সুন্দর গড়ুন ।