স্ট্রোক থেকে মুক্তি : কামরান চৌধুরী

মস্তিষ্কে রক্তনালি বন্ধ হয়ে বা রক্তনালি ছিঁড়ে রক্ত সরবরাহ বিঘ্নিত হলে স্ট্রোক সংঘটিত হয়। একে সেরিব্রোভাসকুলার অ্যাকসিডেন্ট (সিভিএ) বলা হয়। উচ্চ রক্তচাপের কারণে এটা হতে পারে। রক্তে থাকে অক্সিজেন, সেই অক্সিজেনের অভাবে মস্তিষ্কের টিস্যুগুলো মারা যায়। স্ট্রোকের সবচেয়ে বড় কারণ হলো উচ্চ রক্তচাপ।
বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর তৃতীয় কারণ স্ট্রোক। অধিকাংশ মানুষ এর লক্ষণ বুঝতে না পারার কারণে হাসপাতালে রোগীকে আনতে দেরি করেন। অথচ স্ট্রোকের রোগীর জন্য প্রথম চার ঘণ্টা গোল্ডেন আওয়ার বা অতি গুরুত্বপূর্ণ । এই সময়ের মধ্যে হাসপাতালে নিতে পারলে, শুধু ওষুধ দিয়েই রোগী একদিন পরেই সুস্থ শরীরে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারে। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্ট্রোকের রোগীর মৃত্যুঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে আনা প্যারালাইসিস প্রতিরোধ এবং পরবর্তী স্ট্রোকের ঝুঁকি হ্রাসে ফিজিক্যাল মেডিসিন স্পেশালিস্ট ও রিহ্যাবিলিটেশন সেবা সহায়তা করে। সময় মতো এই চিকিৎসা পেলে ৩০ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়ে যায়। অনেকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন।
দেশে এখন ১৫ থেকে ২০ লাখ স্ট্রোকের রোগী রয়েছে। ২৯ অক্টোবর বিশ্ব স্ট্রোক দিবস। ২০২৪ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য- ‘টুগেদার উই ক্যান বি গ্রেটার দেন স্ট্রোক অর্থাৎ আমাদের ঐক্য স্ট্রোকের চেয়েও প্রবল।’ সারা বিশ্বে প্রতি ছয়জনে একজন এই রোগের ঝুঁকিতে আছে। প্রতি বছর প্রায় ১৫০ লক্ষ লোক এ রোগে আক্রান্ত হয় যার মধ্যে ৬০ লাখ লোক মারা যান এবং ৫০ লাখ লোক আজীবনের জন্য বিকলাঙ্গ হয়ে পরেন। বাংলাদেশে প্রতি ১ হাজারে আক্রান্ত হচ্ছে অন্তত ১০ জন। সাধারণত পঞ্চাশোর্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্তের হার বেশি লক্ষ্য করা গেলেও যে কোন বয়সেই তা হতে পারে। ৫০ বছর বয়সের পর প্রতি ১০ বছরে স্ট্রোকের ঝুঁকি দ্বিগুণ হয়। আক্রান্তদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। মহিলাদের মধ্যে স্ট্রোকে আক্রান্তের হার কম।


১৮ কোটি জনসংখ্যার দেশে ৮ থেকে ১০ হাজার ফিজিক্যাল মেডিসিনের চিকিৎসক থাকা দরকার হলেও সংখ্যাটি খুবই কম। এছাড়া দেশে ফিজিওথেরাপিস্ট আছে সাড়ে ৪ হাজারের মতো। অকুপেশনাল থেরাপিস্ট আছে প্রায় ১৫০ জন, আর স্পিচ থেরাপিস্ট ৫০ জনের মতো। নিউরো হাসপাতালে প্রতিদিন ১২০ থেকে ১৪০ জনের মতো রোগী থেরাপি নিয়ে যান। তবে জেলা-উপজেলায় রিহ্যাবিলিটেশন সেবা না থাকায় বিপাকে পড়ছেন রোগীরা। বাধ্য হয়ে তারা ছুটে আসছেন রাজধানী শহরে।

স্ট্রোকে আক্রান্ত রোগী চেনার উপায়—মুখ বেঁকে যাওয়া, হাত একদিকে ঝুঁলে যাবে বা শক্তি কম পাবে, চোখে ঝাপসা দেখা এবং রোগীর কথা জড়িয়ে যাবে। তীব্র মাথা ব্যথা এবং রোগী হঠাত্ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে পারে।
স্ট্রোকের প্রধান কারণ, অতিরিক্ত মোবাইল আসক্তি, ফাস্টফুড, ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত লাইফ স্টাইল। স্ট্রোকের ঝুঁকির কারণগুলি অ-পরিবর্তনযোগ্য (অনিয়ন্ত্রিত) এবং পরিবর্তনযোগ্য (নিয়ন্ত্রণযোগ্য) হতে পারে। অ-পরিবর্তনযোগ্য কারণগুলির মধ্যে রয়েছে বয়স এবং লিঙ্গ, যেখানে পরিবর্তনযোগ্য হৃদরোগের ইতিহাস, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা/অতিরিক্ত ওজন, ব্যায়ামের অভাব, ধূমপান এবং অত্যধিক অ্যালকোহল সেবন অন্তর্ভুক্ত। স্ট্রোক প্রতিরোধে সবার আগে আমাদের লাইফ স্টাইলে পরিবর্তন আনতে হবে। ডায়েট মেনে চলতে হবে ও নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে।

স্ট্রোকের রোগীর রোগ নির্ণয়ে সিটি স্ক্যান প্রয়োজন হয়। উপজেলা পর্যায়ে এই সুযোগ নেই।
২০০৪ সালে কানাডার ভ্যানকুভারে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক কংগ্রেসে প্রথম বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালন করার কর্মসূচি চালু করা হয়। ২০০৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল স্ট্রোক সোসাইটি এবং ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক ফেডারেশন একত্রিত হয়ে ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশন তৈরি করেন যারা পরে বিশ্ব স্ট্রোক দিবস পালনের দায়িত্ব নেন।২০০৭ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশানের অধীনে প্রতিবছর স্ট্রোক সচেতনতা বাড়াতে ‘বিশ্ব স্ট্রোক দিবস’ পালন করা হচ্ছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top