সম্পর্ক ধরে রাখার সেরা উপায় : কামরান চৌধুরী

জীবনে বেঁচে থাকার জন্য সম্পর্ক খুবই জরুরি। মানুষ সামাজিক জীব। এক মানুষের সাথে অন্য মানুষের মাঝে সুন্দর সম্পর্ক জীবনের সবচেয়ে তৃপ্তিদায়ক বিষয়। সেটা বন্ধুত্ব, বিয়ে বা একসাথে থাকার ফলে সৃষ্টি হতে পারে। পারস্পরিক ভালবাসা, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, বোঝাপড়াই যে কোনও সম্পর্কের ভিত্তি। একে অন্যের প্রতি সৎ থাকা। সম্পর্ক মানে শুধু পাশে থাকাই নয়, পাশে না থেকেও যেন পাশে থাকার অনুভুতিটা অনুভব করা যায়। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে প্রত্যেককেই সম্পর্কের প্রতি যত্নশীল হতে হয়। আজকের এই ভিডিওতে কিভাবে একে অপরের সাথে সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলা যায় এবং কিভাবেই বা তার যত্ন নেয়া যায় সেই বিষয়গুলো আমরা জানবো।

একটি সুন্দর সম্পর্ক কি ভাবে গড়ে ওঠে এর কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। তবে কিভাবে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়, বা টিকিয়ে রাখা যায় তার জন্য পরিচর্যা প্রয়োজন। সম্পর্ক অনেকটা বাগানের মতো, গাছের পরিচর্যা বা ফুল ফোটানোর জন্য এর লালন-পালন এবং যত্নের প্রয়োজন হয়। সম্পর্কের শুরুটা যেমন পরিচর্যা দিয়ে হয়, সবসময় সেই পরিচর্যা নাও থাকতে পারে। ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসতে পারে ঝলমলে দিনগুলো। অনেক সময় পরিস্থিতির কবলে পরে সম্পর্কের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। এই পরিবর্তন স্বাভাবিক। কিন্তু এভাবে চলতে দিলে একটা সময় সম্পর্ক টিকিয়ে রাখারই কঠিন হয়। তাই শুরু থেকেই যত্ন নিন। যদি সম্পর্ক কোনো কারণে ম্লান হয়ে গেছে বলে মনে হয় তবে তা আবার আগের মতো প্রাণবন্ত করতে চেষ্টা করতে হবে।

          প্রতিটি জীবনেই কিছু চ্যালেঞ্জ থাকে। অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে ধৈর্যের প্রয়োজন। মাঝে মাঝে ধৈর্য হারিয়ে ঝগড়া করা স্বাভাবিক, তবে একে অন্যের জন্য ধৈর্য ধরে রাখুন। সম্পর্কের মধ্যে দুঃখ ও সুখের মুহূর্ত থাকে। আনন্দ ভাগাভাগি করলে তা দ্বিগুণ হয় এবং কষ্ট ভাগ করলে কষ্ট কমে যায়। সম্পর্ক ভালো রাখতে একজন আরেকজনের পাশে থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

১। মন খুলে কথা বলা- একজন চুপ হয়ে গেলে অন্যজনও চুপ হয়ে যাবেন না। মন খুলে কথা বলুন। সব সময় সংসারের হিসাব-নিকাশ, সমস্যা নিয়ে নয়, নিজেদের ভালোলাগার কিছু নিয়ে, গল্প করুন। আপনার ভয়, আপনার স্বপ্ন, পছন্দের খাবার বা উপহারের আকাঙ্ক্ষা সবকিছু তাকে বলুন। আপনজনের সামনে ইগো ধরে রাখার দরকার নেই। মন খুলে হাসুন, কথা বলুন, এবং এর জাদুকরী প্রভাব দেখুন। সবকিছু আবার প্রাণবন্ত করে দেয়। সঙ্গীর কথা মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করুন।

২। একে অপরকে পুনরায় বুঝতে চেষ্টা করুন- যার হাসি, আচরণ, কথা বলার স্টাইল বা একটুতেই আবেগাক্রান্ত হওয়ার হৃদয়ে আপনি মুগ্ধ হয়েছিলেন। মানুষ হলো ভালো বইয়ের মতো, তার ভেতরে অন্বেষণ করার জন্য অন্তহীন অধ্যায় থাকে। একে অপরকে পুনরায় শিখতে এবং আবিষ্কার করতে সময় নিন। তার সাম্প্রতিক কাজ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করুন, তার আবেগের কথা মন দিয়ে শুনুন এবং বুঝতে চেষ্টা করুন। তার শখগুলোকে সমর্থন করুন। এই পারস্পরিক অন্বেষণ সম্পর্ককে সতেজ রাখে এবং আপনাকে মনে করিয়ে দেয়, কেন আপনি এই আকর্ষণীয় মানুষের প্রেমে পড়েছিলেন।

৩। নতুন কিছু করার চেষ্টা করুন। নতুন কোনো জায়গায় ঘুরতে যান। দু’জন মিলে ঘুরে আসুন কাছে বা দূরে কোথাও। নতুন কোনো শখ পূরণের চেষ্টা করুন। আপনাদের স্বপ্নের কোনো শহর বা স্থানে বেড়াতে যান। মুভি দেখতে বা প্রিয় কোনো রেস্তোরায়, শপিং মলে, কফি আড্ডায়। এগুলো আপনাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে ওষুধের মতো কাজ করবে। প্রায় ভাঙতে বসা সম্পর্ক আবার জোড়া লাগতে শুরু করবে। আপনারা দু’জন দু’জনকে আসলেই কতটুকু চান তা বুঝতে পারবেন। সেভাবেই সম্পর্ক এগিয়ে নিতে পারবেন।

৪। একে অপরকে চমক দিন- আপনাদের সম্পর্কের শুরুতে একে অপরকে সারপ্রাইজ দিতেন নিশ্চয়ই? সেই চমকই আবার ফিরিয়ে আনুন। মানুষ পুরনো হয় না, আপনার আচরণই তাকে পুরনো করে দেয়। ছোট ছোট চমক আপনাদের সম্পর্ককে আবারও রঙিন করে তুলবে। তার পছন্দের খাবারটি তৈরি করে চমকে দিতে পারেন, তার ব্যাগে কিছু টাকা লুকিয়ে রেখে চমকে দিতে পারেন, তার পছন্দের কোনোকিছু না জানিয়ে নিয়ে এসেও চমকে দিতে পারেন। এতে সম্পর্ক সতেজ ও সুন্দর হবে।

৫. কোয়ালিটি টাইম কাটান- ব্যস্ততা জীবনে থাকবে। তারপরও একে অপরের জন্য সময় বের করুন। পর্যাপ্ত সময় না পেলে কোনো সম্পর্কই টিকে থাকে না। কাজ, প্রযুক্তি, আত্মীয়স্বজন সব কিছুর বাইরে নিজেরা কিছুটা সময় কাটান। তার সঙ্গে সময় কাটাতে চাওয়াকে অগ্রাধিকার দিন, সপ্তাহে একদিন হলেও কোয়ালিটি টাইম কাটান। হতে পারে তাই বাইরে কোথাও ডিনার করতে যাওয়া, দু’জনে একসঙ্গে সিনেমা দেখা বা পার্কের মধ্যে হাত ধরে হাঁটা। এটুকু সময় পরস্পরের জন্য থাকুক। নতুন নতুন রঙিন স্মৃতি তৈরি করা। বিশেষ দিনগুলো বিশেষভাবে উদযাপন করা।

৬. মতের অমিল হতেই পারে। দুজনই কথা বলে জানার চেষ্টা করুন কেন আপনাদের মতের অমিল হচ্ছে। কোন বিষয়টিতে আপনারা দ্বিমত প্রকাশ করেন। যখনই বিষয়টি বেরিয়ে আসবে দেখবেন পরে আর আপনাদের মধ্যে মতের অমিল হবে না। দুজনই কী চান সেটি দুজনেরই কাছে প্রকাশ করুন। নিজের ভুল বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে  স্বীকার করা, সরি বলা, সেই সাথে অন্যকে ক্ষমা করে দেওয়া। সম্পর্ক ঠিক রাখতে আপসের বিকল্প নেই। একে অপরকে ছাড় দেওয়ার অভ্যাস করুন। এতে করে সম্পর্ক আরও সুন্দর হয়ে উঠবে।

৭. কথা দিয়ে কথা রাখা। একে অপরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ না করলে যেকোন সম্পর্ক ভেঙে যেতে পারে। একে অপরের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে, সম্মান করতে হবে।   

৮. আপনার পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে উৎসাহিত করা।  বন্ধু বা আপনজনের সাথে সম্মান রেখে কথা বলা।

৯. দুজনে দুজনার গোপনীয়তাকে সম্মান করা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পাসওয়ার্ড না চাওয়া বা মোবাইল চেক না করা।  সুস্থ সম্পর্কের জন্য কিছু কিছু কথা গোপন রাখাও জরুরি। সম্পর্কে ভারসাম্য রাখতে হয়। কী বলবেন আর কতটা বলবেন, সেটা মাথায় রাখা প্রয়োজন।

১০. সকলেই পছন্দমতো হবে এর কোনো মানে নেই। একজন আরেকজনকে বদলাতে না চাওয়া, যে যেমন, তাঁকে সেভাবে মেনে নিয়ে দুজনে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা, আরও পরিণত হয়ে ওঠা। সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার একটাই শর্ত, সঙ্গীর ভালো গুণ গুলোকে দেখা, ত্রুটিগুলোকে নয়। নেতিবাচক নয় ইতিবাচক হতে হবে। সঙ্গীর ত্রুটি সংশোধন করতে পারলে সম্পর্ক  আরো মধুর ও গাঢ় হয়। সমালোচনা পরিহার করে ইতিবাচক কথায় উৎসাহ দিন। ভালোবাসার সম্পর্ক অনেকটা বাতাসের মত, চোখে দেখা না গেলেও অনুভব করা যায় ঠিকই।

১১. সঙ্গীকে বিশ্বাস করা। সম্মান ও গোপনীয়তা রক্ষা করে চলা। ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না করা। পারস্পরিক মূল্য দেয়া। এমন কোনো সম্পর্কে জড়াবেন না যেখানে আপনার কোনো মূল্য নেই।  

১২. প্রতিটি মানুষ স্বতন্ত্র। আপনার নিজস্ব কিছু পছন্দ-অপছন্দ থাকবে। সেটাই স্বাভাবিক। তবে সেটা নিজের মনের মধ্যে চেপে রাখুন। সব কিছু বললে প্রভাব পড়তে পারে সম্পর্কে। সম্পর্কের মাঝে কোনো সমস্যা দেখা দিলে কার দোষ, সেটা নিয়ে ঘাঁটাঘাটি না করে সমাধানের প্রতি মনোযোগী হোন।

১৩. ঘরের কাজ দুজনে মিলে করা। সঙ্গীর কষ্টকে মেনে নিতে শিখুন। ছোট ছোট বিষয়ে ‘কমপ্লিমেন্ট’দেওয়ার অভ্যাস করুন। সেন্স অব হিউমারের পরিচয় দিন।

১৪. দায়িত্ব নেওয়া। বিপদে বা কঠিন সময়ে সঙ্গীর আশেপাশে থাকলে নিরাপদ বোধ করা।

১৫. সম্পর্কে যোগাযোগ অতি গুরুত্বপূর্ণ। এতে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস বজায় রাখতে সাহায্য করে। কোথায় আছেন, কী করছেন, কেন করছেন, কী হয়েছে ইত্যাদি ছোট ছোট বিষয় সঙ্গীর সঙ্গে শেয়ার করলে সব বিষয়ে বোঝাপড়া সহজ হয়।

১৬. সম্পর্কে ‘সীমারেখা’ রাখা। কিছু কিছু কথা বা বিষয় থাকে, সেগুলো একান্ত নিজের। ব্যক্তিগত জীবনের সেইসব গোপনীয়তায় নাক না গলানো।

পরিশেষে বলতে হয়- মানুষ মাত্রই অহংকারী হয়।  কিন্তু যারা সম্পর্ককে মূল্য দিতে জানে তারাই মাথা নত করতে পারে। কথা বলার ধরনই বলে দেয় সম্পর্কের মধ্যে গভীরতা এবং ঘনিষ্ঠতা ঠিক কতটা। সম্পর্ক গড়া কঠিন ভাঙা অতি সহজ। কোন সম্পর্কই পারফেক্ট হতে পারে না, একটু মানিয়ে নিতে পারলেই ভালো সম্পর্ক গড়া যায়। সম্পর্কে তারাই সবচেয়ে বেশি সুখী যারা একে অপরের দোষ-ত্রুটি মেনে নিয়ে নিজেদেরকে শোধরাতে পারে। সম্পর্ক ভালো রাখতে একে অপরের প্রতি অনুগত থাকা আবশ্যক। জীবনে যাই ঘটে যাক না কেন, একসঙ্গে থাকতে হবে। এমন প্রতিশ্রুতি মিষ্টি সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। চলুন আমরা আমাদের সম্পর্ককে মধুর করে তুলি। সম্পর্কের প্রতি আরো যত্নশীল হই। সুস্থ সমাজ গড়ে তুলি। চ্যানেলটি ভালো লাগলে সাবস্ক্রাইব করে যুক্ত থাকুন। এবং বেশি বেশি শেয়ার করে অন্যদেরকে জানার সুযোগ করে দিন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top