আকাশের রং আজ একটু বেশি নীল। মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে ধীরে ধীরে। ষোলো বছরের রাহুল স্কুল থেকে ফিরে বাসায় ঢুকতেই মায়ের কাছ থেকে একটি অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব শুনলো।
“রাহুল, আজ তোর স্কুলের প্রজেক্টের কাজ শেষ হয়ে গেছে তো? যদি সময় থাকে, একবার শহরের সেই নতুন বৃদ্ধাশ্রমটা দেখে আসতে পারিস?” মা হাসিমুখে বললেন।
“বৃদ্ধাশ্রম?” রাহুলের ভ্রু কুঁচকে গেল, “সেখানে কেন যাবো?”
“তোর দাদু সেখানে থাকেন। অনেকদিন দেখা হয়নি। আজ একবার গিয়ে দেখা করলে খুশি হবেন।”
সেই বৃদ্ধাশ্রমেই তোর দাদু একা থাকে। তোর দিদা মারা যাবার পর কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল তোর দাদু। তোর বাবার সাথে প্রায়ই মনোমালিন্য হতো বিভিন্ন বিষয় নিয়ে।
রাহুলের মনে পড়ল, বছর তিনেক আগে দাদুকে তারা এই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছিল। তখন সে খুব ছোট ছিল। দাদুর কথা মনে পড়তেই তার বুকটা একটু কেঁপে উঠল।
বৃদ্ধাশ্রমের গেট পার হওয়ার সাথে সাথেই রাহুলের মনে হলো, এ যেন কোনো ভিন্ন পৃথিবী।
সবুজ ঘাসের মাঠ, ছোট ছোট গাছ পায়ে চলা রাস্তায় ছায়া দিয়ে রেখেছে যেন শাড়ির আঁচলে ঢাকা। পরিপাটিভাবে সাজানো বাগান, নানারকম ফুল ফুটে আছে গাছে।
কয়েকটি বেঞ্চে বসে কয়েকজন বৃদ্ধ হাসি-গল্পে মগ্ন। কেউবা একা বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে। কেউ নিরবে বসে আছে, চোখে-মুখে-কপালে চিন্তার ভাঁজ।
একজন একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সারি বেধে চলা পিপড়ের দিকে। রাহুলের পায়ের নিচের মাটি যেন নরম হয়ে গেল। চারপাশের দৃশ্য দেখে তার ভেতরে কান্না চলে এলো। তার দুচোখ খুজতে লাগলো একজনকে। কিন্তু এখানে সে তার দাদুকে দেখতে পেলো না।
বৃদ্ধাশ্রমের অফিসে গিয়ে দাদুর রুম নম্বর জেনে নিল সে। করিডোর ধরে হাঁটতে হাঁটতে তার হৃদয় দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছিল। শেষমেশ ১০৭ নম্বর রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দরজায় আস্তে করে নক করলো।
“কে?” ভেতর থেকে কর্কশ একটি কণ্ঠস্বর এলো।
রাহুলের গলা শুকিয়ে গেল, “আমি… আমি রাহুল।”
দরজা খুলে দাদু বেরিয়ে এলেন। চোখেমুখে অবিশ্বাস, তারপরই সেই চোখ ছলছল করে উঠল।
“রাহুল… আমার নাতি?” দাদুর কণ্ঠে কাঁপুনি।
দাদু তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। রাহুলের গাল বেয়ে অজান্তেই পানি গড়িয়ে পড়ল। দাদুর শরীর থেকে একটা মিশ্র গন্ধ আসছিল— ওষুধের গন্ধ, পুরনো স্মৃতির গন্ধ।
রাহুল জিজ্ঞেস করল “দাদু, কাঁদছ কেন?”।
দাদু তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “বাবা, তোরা সবাই আমাকে ভুলে গেছিস। আজ তিন বছর পর তুই দেখা করতে এসেছিস…”
রাহুলের বুকের ভেতরটা যেন চেপে ধরে রাখল কেউ। সে কোনো উত্তর দিতে পারল না। ঠিকইতো সেই কবে বাবা-মা এসে দাদুকে এখানে রেখে গেছে। আমাকে কখনো আনেনি দাদুর কাছে। মাঝে-মধ্যে শুনতাম দাদুকে দেখে গিয়েছে মা।
দাদু তাকে রুমের ভেতর নিয়ে গেলেন। ছোট্ট একটি খাট, একটা আলমারি আর টেবিল।
টেবিলের উপর পানির জগ, গ্লাস, একটা ছোট বক্স সেখানে কিছু ঔষুধ রাখা। এই নিয়ে তার জগৎ। দাদু তাকে পাশে বসালেন। রাহুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন কয়েকবার। তারপর বলতে লাগলেন-
“রাহুল, তোর বাবা যখন তোর বয়সী ছিল, তখন আমি তাকে কীভাবে মানুষ করেছি, জানিস?” দাদু হঠাৎ বললেন।
রাহুল মাথা নাড়ল, “না দাদু, তুমি বলো।”
দাদুর চোখে তখন দূরের কোনো স্মৃতি ভেসে উঠল, “তোর বাবা খুব দুষ্টু ছিল। একদিন সে স্কুল থেকে চুরি করে একটা পেন এনেছিল। আমি যখন জানলাম, তখন খুব মারধর করিনি, বকাও দিইনি। বরং তাকে বললাম— ‘মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ হল তার চরিত্র। যদি সততা হারিয়ে ফেলিস, তবে জীবনে কিছুই থাকবে না।'”
দাদু একটু থামলেন, তারপর, বললেন, “সেদিন তোর বাবা কেঁদে কেঁদে ক্ষমা চেয়েছিল। আর আজ তোর বাবা একজন সফল ব্যবসায়ী।
একবার তোর বাবা পাড়ার বন্ধুদের সাথে মারামারি করে এসেছিল। খারাপ সঙ্গে মিশেছিল। আমি তখন অনেক বুঝিয়ে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম। সে খারাপ সঙ্গ ত্যাগ করে জীবনকে ভালোবেসেছিল। আজ সমাজে সে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু…”
দাদুর গলার স্বর ভারী হয়ে এল, “আজ সে আমাকে এই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছে।”
রাহুলের চোখে জল। দাদু তার হাত ধরে বললেন, “শোন রাহুল, জীবন খুব ছোট। আজ আমি বৃদ্ধ, তুইও একদিন এই বয়সে পৌঁছাবি। তখন তোর সন্তানরা যদি তোকেও ভুলে যায়, তোর কেমন লাগবে?”
রাহুল নীরবে শুনতে লাগল।
দাদু বললো, “জীবনে তিনটি জিনিস কখনো ভুলিস না— পরিবারের মর্যাদা, মানুষের প্রতি দয়া, এবং নিজের মূল্যবোধ। এই তিনটা জিনিস যদি ধরে রাখতে পারিস, তোর জীবন সার্থক হবে।”
সময় যেন পাখির ডানার মতো চলে গেল। রাহুলের ফিরে যাওয়ার সময় হয়ে এল।
দাদু তাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। গেটের দিকে আসতে কয়েকজন বৃদ্ধের সাথে দেখা।
দাদু তাদেরকে রাহুলকে দেখিয়ে বলছে আমার দাদুভাই এসেছে দেখা করতে।
নিথর দৃষ্টিতে তারা তাকিয়ে ছিল। কেউবা বললো ভালো, কেউবা চুপচাপ, কোনো ভ্রুক্ষেপ হলো না দাদুর কথায়।

“দাদু, আমি আবার আসব,” রাহুল বলল।
দাদু হাসলেন, “আসবি নাতি, কিন্তু শুধু আমার জন্য নয়।
এখানে আরও অনেক বৃদ্ধ আছেন, যাদের কেউ দেখতে আসে না। যদি সময় পাস, তাদেরও একটু সময় দিবি।”
রাহুল মাথা নাড়ল। গেটের বাইরে পা রাখতেই সে পিছনে ফিরে তাকাল। দাদু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছিলেন।
সেই দৃশ্য তার হৃদয়ে গভীর দাগ কেটে গেল।
বাসায় ফেরার পথে রাহুলের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল দাদুর কথা।
সে ভাবছিল, “আমরা কি আসলেই এত ব্যস্ত যে আমাদের পরিবারের মানুষগুলোর জন্য সময় বের করতে পারি না?
যারা আমাদের বড় করেছেন, তাদের শেষ বয়সে আমরা কি শুধুই ভুলে যাব?”
বাড়িতে একসাথে থাকা যায় না কেন? আমরা কেন এতো স্বার্থপর হয়ে যাই?
সেদিন রাহুলের জীবনের মোড় ঘুরে গেল। সে সিদ্ধান্ত নিল, সে নিয়মিত দাদুর কাছে যাবে।
শুধু দাদু নয়, বৃদ্ধাশ্রমের অন্য মানুষদেরও সময় দেবে। তাদের সাথে খেলা করবে, গল্প করবে।
তাদের জীবনের গল্প শুনবে, সমাজের নতুন নতুন পরিবর্তনগুলো সে তাদেরকে জানাবে।
জীবন খুব দ্রুত চলে যায়। আজ আমরা যাদের অবহেলা করি, কাল হয়তো তাদের জন্য আমাদের হৃদয় কাঁদবে।
বৃদ্ধাশ্রমের সেই একদিন রাহুলকে শিখিয়ে দিয়েছিল— “প্রত্যেকের জীবনের শেষ অধ্যায়ে একটু ভালোবাসা,
একটু সম্মানই পারে তাদের জীবনকে আলোকিত করতে।”
আর তাই, রাহুলের মতো আমাদেরও উচিত একটু পিছনে ফিরে তাকানো—
যারা আমাদের আগলে বড় করেছেন, তাদের জন্য একটু সময় দেওয়া। কারণ, পরিবারই হলো জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
