আত্মা এক অদৃশ্য সত্ত্বা যা মানুষের শরীরে বা স্বাধীনভাবে বসবাস করে। আত্মা সংস্কৃত শব্দ যা ব্যক্তির আত্ম বা স্ব-অস্তিত্বের সারাংশকে বোঝায়। আত্মা জীবের অংশ যা কোনো শরীর নয়। দেহ যখন জীবিত থাকে, তখন এর ভেতরে একটি আত্মা থাকে। আর মৃত্যুর সময় আত্মা দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। আত্মা আল্লাহ তায়ালার এক বিস্ময়কর ও রহস্যময় সৃষ্টি। আত্মা দেহকে সঞ্জীবিত করে তোলে এবং দেহে গতি সঞ্চার করে। দেহ ছাড়াও আত্মা থাকতে পারে তবে আত্মা ছাড়া দেহ অচল।
আত্মা চিরন্তন, অবিনশ্বর, কালের বাইরে, “শরীর বা মন বা চেতনার মতো নয়। আত্মা অপরিবর্তনীয়, অন্তরতম দীপ্তিময় স্বয়ং যা ব্যক্তিত্ব দ্বারা প্রভাবিত নয়, অহং দ্বারা প্রভাবিত নয়; চির-মুক্ত, অসীম যা সীমাবদ্ধ নয়। আত্মার উপলব্ধি করা উদ্দেশ্য, অর্থ, জীবনের মুক্তি।
আত্মাকে জানলেই সবকিছু জানা হয়ে যায়। আত্মা সব জগতে পরিব্যাপ্ত। আত্মাকে আরবি ভাষায় ‘রুহ’ বলা হয়। প্রতিটি জীবের শরীরে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আত্মা বিদ্যমান থাকে। ওই সময়টুকুকে আমরা ‘হায়াত’ বলে জানি। আত্মা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য প্রাণীর দেহে অবস্থান করে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তারা তোমাকে আত্মা সম্পর্কে প্রশ্ন করে। তুমি বলো, আত্মা আমার প্রতিপালকের আদেশবিশেষ। আর তোমাদের সামান্য জ্ঞানই দান করা হয়েছে।’ (সুরা, আয়াত : ৮৫)
মানবদেহে প্রবেশ করানোর আগে আত্মাগুলো আত্মার জগতে থাকে। সেখানে যার আত্মার সঙ্গে যার আত্মার পরিচয় থাকে, তাদের সঙ্গে দুনিয়াতে বন্ধুত্ব ও প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি হয়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আত্মা স্বভাবজাত সমাজবদ্ধ। সেখানে যেসব রুহ পরস্পর পরিচিতি লাভ করেছিল দুনিয়াতে সেগুলো সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে থাকে।
আত্মার দুটি প্রবৃত্তি রয়েছে। সুপ্রবৃত্তি এবং কুপ্রবৃত্তি। সুপ্রবৃত্তি মানুষকে ন্যায়, সৎ ও সঠিক পথ নির্দেশ করে। অন্যদিকে কৃপ্রবৃত্তি মানুষকে অন্যায়, অসৎ ও বিপথে পরিচালিত করে। ইসলাম মানুষের আত্মাকে সাধারণত তিন স্তরে বিন্যস্ত করে। ক. নফসে আম্মারা বা কুপ্রবৃত্তিমূলক আত্মা, খ. নফসে লাওয়ামাহ বা বিবেকতাড়িত এবং গ. নফসে মুতমাইন্না বা প্রশান্ত আত্মা।
মানুষের মন মন্দকর্মপ্রবণ। দুনিয়াতে অনেক কিছু রয়েছে যা মানুষকে লোভনীয় ও আকৃষ্ট করে এবং বিপথে পরিচালিত করে। তবে মানুষের মাঝে বুদ্ধি-বিবেক বা সুআত্মা বিদ্যমান বিধায় সে হীন-নীচ-কদর্য পথ থেকে বিরত থাকতে সমর্থ হয়। পক্ষান্তরে কারো মাঝে পশুবৃত্তির আধিক্য থাকলে মানুষ সহজেই মন্দ-অশ্লীল, খারাপ অন্যায় কুপ্রবৃত্তি ও কুবাসনাজনিত কাজে প্রলুব্ধ হয় এবং নিজেকে পাপে নিমজ্জিত করে।
ঈমান, ইবাদত-বন্দেগী, কোরান তেলাওয়াত, জিকির-আজকারসহ অন্যান্য ভালো কাজ এবং সাধনার দ্বারা ক্রমাগত আত্মার উন্নতি সাধিত হয়। এভাবেই কুপ্রবৃত্তিমূলক আত্মা ধীরে ধীরে প্রশান্ত আত্মায় রূপ নেয়। প্রশান্ত আত্মা হচ্ছে সর্বপ্রকার কলুষতা থেকে মুক্ত বিশুদ্ধ পবিত্র ও খাঁটি আত্মা। পশুবৃত্তি ও জীববৃত্তি এবং সব ধরনের কুপ্রবৃত্তি এখানে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়ে যায়, বুদ্ধি ও বিবেকের প্রাধান্যে ঐশী জ্যোতিতে এ আত্মা হয়ে ওঠে নির্মোহ আত্মা। আল্লাহর গভীর ধ্যান ও প্রেমই এই আত্মার বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর জিকির ও স্মরণ ছাড়া এই আত্মায় আর কিছুই থাকে না। এমন আত্মার অধিকারী থেকে কোনো অনাচার-পাপাচার সম্ভব নয়।
মানুষের কৃতকর্মের ওপর ভিত্তি করে আত্মা পবিত্র বা অপবিত্র হয়। মানুষ যদি ঈমান আনে, নেক আমল করে, আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলে, তাহলে তাদের আত্মা পবিত্র থাকে, আর যদি তা না করে, তাহলে তাদের আত্মা অপবিত্র হয়ে যায়। এবং তা নিকৃষ্ট আত্মাতে পরিণত হয়। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, মৃত্যুর সময় মানুষের কাছে ফেরেশতা আগমন করে। অতএব মুমূর্ষু ব্যক্তি নেককার হলে তারা বলেন, হে পবিত্র আত্মা, পবিত্র দেহ থেকে প্রশংসিত অবস্থায় বের হয়ে এসো এবং আল্লাহর রহমত ও সুঘ্রাণের সুসংবাদ গ্রহণ করো। তোমার রব তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট নন। রুহ বের হয়ে আসা পর্যন্ত তারা এভাবে আহ্বান জানাতে থাকে। অতঃপর রুহ বের হয়ে এলে তারা তা নিয়ে আসমানে আরোহণ করেন। এ রুহের জন্য আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হয়। জিজ্ঞেস করা হয়, সে কে? ফেরেশতারা বলেন, অমুক ব্যক্তি। তখন বলা হয়, পবিত্র আত্মাকে স্বাগতম, যা ছিল পবিত্র দেহে। প্রশংসিত অবস্থায় তুমি প্রবেশ করো। আল্লাহর রহমত ও সুঘ্রাণের সুসংবাদ গ্রহণ করো। তোমার রব তোমার প্রতি অসন্তুষ্ট নন। তাকে অবিরত এ সংবাদ প্রদান করা হয়—ততক্ষণ অবধি, যখন তা মহামহিম আল্লাহ যে আসমানে অবস্থান করেন সেখানে পৌঁছে যায়। মুমূর্ষু ব্যক্তি পাপাচারী হলে ফেরেশতা বলেন, হে নিকৃষ্ট দেহের নিকৃষ্ট আত্মা, নিন্দিত অবস্থায় বের হয়ে আসো এবং উত্তপ্ত গরম পানি ও রক্ত-পুঁজের দুঃসংবাদ গ্রহণ করো এবং অনুরূপ বহু বিষাক্ত বস্তুর। রুহ বের হয়ে আসা পর্যন্ত তারা এভাবে আহ্বান জানাতে থাকেন। অতঃপর তাঁরা রুহসহ ঊর্ধ্বাকাশে আরোহণ করেন। কিন্তু তার জন্য দরজা খোলা হয় না। জিজ্ঞেস করা হয়, এ ব্যক্তি কে? বলা হয়, অমুক। তখন বলা হয়, নিকৃষ্ট দেহের নিকৃষ্ট আত্মার জন্য নেই কোনো সাদর সম্ভাষণ। তুই নিন্দিত অবস্থায় ফিরে যা। কারণ তোর জন্য আকাশের দ্বার খোলা হবে না। অতঃপর তাকে আসমান থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় এবং তা কবরে ফিরে আসে। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪২৬২)।
মানুষের কৃতকর্মের ওপর ভিত্তি করে আত্মা পবিত্র-অপবিত্র হয়। যাদের আত্মা পবিত্র, পরকালীন যাত্রায় তাদের সংবর্ধনা দেওয়া হয়, আর যাদের আত্মা অপবিত্র তাদের পরকালীন যাত্রা অত্যন্ত অপমানজনক হয়। কাজেই বেশি বেশি নেক আমলের মাধ্যমে আত্মার পরিচর্যা করা জরুরি। বেশি বেশি নেক আমল আত্মা পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করে তোলে।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে প্রশান্ত আত্মা, তুমি তোমার রবের কাছে ফিরে এসো সন্তুষ্ট ও সন্তোষভাজন হয়ে। আর আমার বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হও এবং আমার জান্নাতে প্রবেশ করো।’ (সুরা : ফাজর, আয়াত : ২৭-৩০)
আল্লাহর সৃষ্টিতত্ত্বের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আধ্যাত্ম চেতনা, অন্যদিকে মানবজীবনের মূল মর্ম হলো আত্মশুদ্ধি। তাই মানুষের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক সুগভীর। পৃথিবীতে যত নবী-রাসুল ও ঐশী ধর্মগ্রন্থ যার একমাত্র মিশন ছিল মানবাত্মার সংশোধন। মানবাত্মা হলো শাসক, আর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার প্রজা। শাসক ভালো হলে প্রজারাও ভালো হয়, আর শাসক খারাপ হলে তার প্রজারাও খারাপ হয়। আত্মার সংশোধন শুধু একজন মানুষের জন্যই নয়; বরং ইহকালীন জীবনের শান্তি-শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধি সব এর ওপরই নির্ভর করে। মানুষের অধ্যাত্ম চেতনা ও আত্মশক্তির অনন্য চালিকাশক্তি হলো ‘কাল্ব’বা অন্তঃকরণ। এর সুস্থতার সঙ্গে দেহ-মনের সুস্থতা সম্পৃক্ত। রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘সাবধান! নিশ্চয়ই প্রত্যেক দেহে একটি গোশতের টুকরা রয়েছে। যখন সেটি ঠিক থাকে, তখন দেহের অন্য অঙ্গগুলোও ঠিক হয়ে যায়। আর যদি তা বিনষ্ট হয়, তাহলে সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হয়ে যায়। এর নাম হলো কাল্ব বা মানবাত্মা।’ (বুখারি ও মুসলিম)
মানুষের ভেতরে দুটো সত্ত্বা রয়েছে—জীবাত্মা ও পরমাত্মা। জীবাত্মাকে নফস এবং পরমাত্মাকে ‘রুহ বলা হয়েছে। নফসের তাড়না একধরনের আত্মিক রোগ। দেহের যেমন রোগ হয়, আত্মারও তেমনি রোগ আছে। কলব বা আত্মার এই রোগ না সারাতে পারলে মানবজীবনই বৃথা। তাইতো সুফিসাধকগণ নফসের পরিশুদ্ধতার শিক্ষা দেন। মানুষের কলবের দুটি মুখ রয়েছে। একটি নফসের দিকে, আর অপরটি রুহের দিকে। জীবাত্মা যতক্ষণ কুরিপুর তাড়নাযুক্ত থাকে ততক্ষণ সে থাকে রুহের প্রতি অমনোযোগী। এ অবস্থায় জীবাত্মা স্বেচ্ছাচারী হয়। তখন রুহের কোন নির্দেশ তার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে না। সাধনার মাধ্যমে স্বেচ্ছাচারী জীবাত্মা রূহের প্রতি মনযোগী হলে তখন খেয়াল থাকে কলবের ভেতরে।
কলব সূক্ষ্ম সৃষ্টি জগতের রহস্যময় এক মহাসমুদ্র। সূক্ষ্ম জগত্ স্তরে স্তরে এই কলবের ভেতর অবস্থান করে। মানুষের জীবাত্মা তার কলবের বাইরের অঙ্গের সঙ্গে যুক্ত। আর মানবাত্মা এর ভেতরের স্তর সমূহের সঙ্গে সম্পৃক্ত। জগতের সকল কিছুর মতো কলবেরও জাহের এবং বাতেন আছে।
মানুষের আত্মাই দেহের নিয়ন্ত্রক। অন্তর যদি নিজে কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে, তবে সারা শরীরের কার্যকলাপও সঠিক থাকবে। পক্ষান্তরে অন্তর যদি সঠিকভাবে কাজ না করে, তবে শরীরের সব ব্যবস্থাপনাও বিনষ্ট হবে। তাই সবার আগে আত্মাকে ঠিক করা দরকার। আত্মার ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে তার স্বচ্ছতা ও মলিনতা। লোহা কিছুদিন মাটিতে পড়ে থাকলে যেমন মরিচা ধরে, নষ্ট হয়ে যায়, তদ্রূপ আত্মাকে সঠিকভাবে পরিচালনা না করা হলে লোহার মতোই মরিচাপ্রাপ্ত হয়ে মূল্যহীন হয়। এর মধ্যে অসৎ চিন্তা এবং কুধারণা বাসা বাঁধতে থাকে। একপর্যায়ে তা আর সঠিকভাবে কাজ করে না। এভাবেই মানুষ তার সৎ কর্ম করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। নবী করিম (সা.) যথার্থই বলেছেন, ‘লোহার মতো আত্মাও মরিচাপ্রাপ্ত হয়।’ (তিরমিজি)। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার শক্তিই নফস বা কুপ্রবৃত্তিকে দমন করতে পারে, মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করতে পারে এবং এর মাধ্যমেই রুহানি চেতনা বিকশিত হয়।
নফস ও রূহের মধ্যে পার্থক্য হলো- দেহ ও আত্মার মিলিত সত্ত্বাকে ‘নফস’ বলা হয়। আর শুধুমাত্র আত্মাকে ‘রূহ’ বলা হয়। যেমন প্রাণীকে ‘নফস’বলা হয়। কিন্তু ‘রূহ’ বা আত্মা বলা হয় না। সুরা আলে ইমরান ১৮৫ আয়াতে আল্লাহ বলেন, প্রত্যেক প্রাণী মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। নফসের পরিশুদ্ধকরণের মাধ্যমেই আত্মশুদ্ধি ও মু্ক্তি অর্জন সম্ভব। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরানে বলেছেন- “তোমরা তোমাদের নফসকে হত্যা করো (কুপ্রবৃত্তি দমন করো), তোমাদের স্রষ্টার নিকট ইহাই শ্রেয়।” সূরা বাকারা, আয়াত নং- ৫৪ অস্বচ্ছ ময়লাযুক্ত অন্তর নিয়ে কখনো আল্লাহকে পাওয়া যায় না বা ভালো কিছু করা যায় না। তাই আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করতে হলে এবং বৃহত্তর কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করতে হলে আত্মশুদ্ধি অবশ্যই জরুরি। আত্মিক পরিশুদ্ধতা ও অধ্যাত্ম শক্তি ছাড়া মানবজীবন ব্যর্থ ও বিফল।