বজ্রপাতের কারণ

বজ্রপাতের কারণ প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা

দুর্যোগপ্রবণ দেশ বাংলাদেশে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বজ্রপাতের কারণে মৃত্যু ও আহতের সংখ্যা ও তীব্রতা বাংলাদেশে আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন ইত্যাদির পাশাপাশি বজ্রপাত একটি মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগে পরিণত হয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় কৃষক ও মাঠে কর্মরত শ্রমিকরা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এই নিবন্ধে আমরা বাংলাদেশে বজ্রপাতের কারণগুলো, তাৎক্ষণিক প্রতিকার ও দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

বজ্রপাত কী?

বজ্রপাত হলো আকাশে সৃষ্ট একটি প্রাকৃতিক বৈদ্যুতিক নির্গমন, যা বিদ্যুৎ চমক ও গর্জনের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এটি সাধারণত বজ্রঘন মেঘের (Cumulonimbus) মধ্যে বা মেঘ থেকে মাটিতে ঘটে থাকে। যখন দুই ভিন্ন ধরণের বৈদ্যুতিক চার্জের মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হয়, তখন সেই শক্তি দ্রুত নির্গত হয়ে বজ্রপাত সৃষ্টি হয়।

বাংলাদেশে বজ্রপাতের হার

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত এক দশকে বজ্রপাতের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। প্রতি বছর গড়ে ২০০-৩০০ মানুষ বজ্রপাতে প্রাণ হারান। সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত হয় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে অর্থাৎ এপ্রিল থেকে জুন মাসে, বিশেষ করে দিনের বেলা ১২টা থেকে ৫টার মধ্যে।

বাংলাদেশে বজ্রপাতের কারণ

বংলাদেশে বিভিন্ন কারণে বজ্রপাত হয়। আর বজ্রপাতের কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

১. ভৌগোলিক অবস্থান

বাংলাদেশের অবস্থান ট্রপিক্যাল মৌসুমি জলবায়ু অঞ্চলে, যেখানে প্রচুর বজ্রঝড় সৃষ্টি হয়। বঙ্গোপসাগর থেকে আসা আর্দ্র বায়ু এবং উত্তরের শুষ্ক বায়ুর সংঘর্ষে বজ্রমেঘ তৈরি হয়।

২. জলবায়ু পরিবর্তন

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বেড়েছে এবং বায়ুমণ্ডলে আর্দ্রতা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বায়ুমণ্ডলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ফলে বজ্রপাতের সংখ্যা ও তীব্রতা দুটোই বাড়ছে।

৩. বন উজার ও উঁচু গাছপালা হ্রাস

প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ধ্বংস হলে বজ্রপাতের প্রভাব আরও তীব্র হয়। বনাঞ্চল বজ্রপাতের বিদ্যুৎকে শোষণ করে নিতে পারে, কিন্তু গাছপালা না থাকলে তা সরাসরি মানুষের ওপর আঘাত হানে।

শহরায়ন ও কৃষিজমি বিস্তারের কারণে দেশে উঁচু গাছের সংখ্যা কমে গেছে। আগে এই গাছগুলো বজ্রপাত আকর্ষণ করে ভূমিতে আঘাত হানার আগেই শক্তি নিঃশেষ করত।

৪. মোবাইল টাওয়ার ও বিদ্যুতের খুঁটি

গ্রামীণ এলাকায় ব্যাপক হারে মোবাইল টাওয়ার স্থাপন এবং বিদ্যুতের খুঁটির সংখ্যা বৃদ্ধি বজ্রপাতের ঝুঁকি বাড়িয়েছে। এই ধাতব কাঠামোগুলো বজ্রপাত আকর্ষণ করে।

৫. খোলা মাঠে কাজ

বাংলাদেশে অনেক মানুষ ধানক্ষেত, নদীর ধারে বা উন্মুক্ত স্থানে কাজ করেন। এই অবস্থায় থাকলে বজ্রপাতের সময় সরাসরি আঘাত পাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

৬. মাটি ও ভূ-প্রকৃতি

বাংলাদেশের মাটি ও ভূপ্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য বজ্রপাতের বিদ্যুৎ সহজে পরিবাহিত করে। ফলে মাটিতে থাকা বা খোলা জায়গায় অবস্থান করা অত্যন্ত বিপজ্জনক।

৭. জনসচেতনতার অভাব

বজ্রপাতের সময় নিরাপদ আচরণ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে, বিশেষ করে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে।

বজ্রপাতের লক্ষণ

আকাশে ঘন কালো মেঘ জমা হওয়া

বারংবার বিদ্যুৎ চমকানো

উচ্চ শব্দে বজ্র গর্জন

হঠাৎ বাতাসের বেগ বৃদ্ধি

এইসব লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেওয়া উচিত।

বজ্রপাতের ক্ষতিকর প্রভাব

১. প্রাণহানি

প্রতি বছর বাংলাদেশে শত শত মানুষ বজ্রপাতে মারা যায়। ২০১৬ সালে মাত্র দুই দিনে ৮১ জন মারা যান, যা পরিস্থিতির ভয়াবহতা প্রকাশ করে।

২. আহত ও অঙ্গহানি

বজ্রপাতের ফলে অনেকেই পঙ্গু হয়ে যান বা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। বিদ্যুতের তীব্রতায় দগ্ধ হওয়া বা শ্রবণ শক্তি হারানো সাধারণ ঘটনা।

৩. পশুসম্পদের ক্ষতি

গবাদিপশু বজ্রপাতের সময় খোলা মাঠে থাকলে তারা মারা যেতে পারে, যা কৃষকদের জন্য বড় ক্ষতি।

৪. ঘরবাড়ি ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ক্ষতি

বজ্রপাতের ফলে বৈদ্যুতিক সার্কিটে শর্ট সার্কিট হতে পারে, যার কারণে আগুন লাগা বা বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

বজ্রপাতের সময় করণীয় (তাৎক্ষণিক প্রতিকার)

১. নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ

বজ্রঝড় শুরু হলে দ্রুত পাকা বাড়ির ভিতরে চলে যান। যদি পাকা বাড়ি না থাকে, তবে গাড়ির ভিতরেও আশ্রয় নিতে পারেন। পাকা বাড়িতে থাকলে বাড়ান্দায় বা জানালার গ্রিল ধরে না দাঁড়ানো।

২. উন্মুক্ত স্থান এড়িয়ে চলা

মাঠ, নদী বা উন্মুক্ত স্থানে থাকা অবস্থায় বজ্রপাত শুরু হলে নিচু হয়ে বসুন, কিন্তু মাটিতে শুয়ে পড়বেন না। একা না থেকে দলবদ্ধভাবে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিন

৩. গাছ থেকে দূরে থাকা

বজ্রপাতের সময় কোন অবস্থাতেই বড় গাছের নিচে দাঁড়াবেন না। গাছ বজ্রপাত আকর্ষণ করতে পারে।

৪. ধাতব বস্তু স্পর্শ থেকে বিরত থাকা

বজ্রপাতের সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার, ধাতব গয়না বা অন্য কোন ধাতব বস্তু স্পর্শ থেকে বিরত থাকুন।

৫. বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার না করা

বজ্রপাতের সময় টিভি, কম্পিউটার বা অন্য কোন বৈদ্যুতিক যন্ত্র ব্যবহার করবেন না এবং প্লাগগুলো খুলে রাখুন।

মোবাইল ফোন, ছাতা ও ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার বন্ধ করুন।

খোলা মাঠ, জলাশয়, গাছপালা ও ধাতব বস্তু থেকে দূরে থাকুন।

৬। পায়ে রাবার বা প্লাস্টিকের সোল যুক্ত জুতা পরুন

৭। মাঠে কাজ করার সময় আকাশের অবস্থা খেয়াল রাখা

বজ্রপাত শুরু হলে ধানক্ষেত বা জলাশয় থেকে দ্রুত নিরাপদ স্থানে আসা । গবাদিপশু খোলা মাঠে না রাখা।

বজ্রপাত আক্রান্তের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা

কেউ বজ্রপাতে আক্রান্ত হলে দ্রুত নিচের ব্যবস্থা নেয়া:

১। আক্রান্ত ব্যক্তিকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে আনুন। হৃদস্পন্দন ও শ্বাস-প্রশ্বাস পরীক্ষা করুন।

CPR (Cardiopulmonary Resuscitation) দিন, যদি প্রয়োজন হয়। দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যান

২. মানসিক সহায়তা

বজ্রপাতে বেঁচে যাওয়া অনেক মানুষ মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হন। তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রদান করা জরুরি।

৩. সরকারি সহায়তা

আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য জরুরি চিকিৎসা, আর্থিক সহায়তা এবং পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

দীর্ঘমেয়াদী প্রতিরোধ ব্যবস্থা

১. বজ্রপাত নিরোধক স্থাপন

সরকারি ভবন, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল ও জনসমাগমস্থলে বজ্রপাত নিরোধক (Lightning Arrester) স্থাপন করতে হবে। গ্রামীণ এলাকায় মসজিদ, মন্দির ও স্কুলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

২. বজ্রপাত পূর্বাভাস ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বজ্রপাত পূর্বাভাস ব্যবস্থা আধুনিকায়ন করতে হবে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে দ্রুত সতর্কবার্তা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।

৩. মোবাইল অ্যাপ ও প্রযুক্তির ব্যবহার

বাংলাদেশ সরকার এবং বেসরকারি সংস্থা বজ্রপাত পূর্বাভাস দেওয়ার জন্য অ্যাপ চালু করেছে, যেমন ‘বজ্রপাত সতর্কীকরণ অ্যাপ’। এটি ব্যবহার করে মানুষ আগেই সতর্ক হতে পারে।

৪. গণসচেতনতা বৃদ্ধি

গ্রাম গঞ্জ ও শহরে বজ্রপাতের ঝুঁকি, প্রতিকার ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা বজ্রপাত সম্পর্কে গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মিডিয়া ক্যাম্পেইন, স্কুল-কলেজে সচেতনতামূলক ক্লাস এবং কমিউনিটি ভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং বিদ্যালয়গুলো এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

৫. বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ

উঁচু গাছ যেমন তাল, সুপারি, নারিকেল গাছ রোপণ করতে হবে। এসব গাছ বজ্রপাত আকর্ষণ করে ভূমিতে আঘাত হানার ঝুঁকি কমায়। বন রক্ষা বজ্রপাত কমাতে সহায়তা করতে পারে। এসব পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা বজ্রপাতের প্রকোপ হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৬. নিরাপদ কৃষি পদ্ধতি

কৃষকদের বজ্রঝড়ের সময় মাঠে কাজ না করার জন্য উৎসাহিত করতে হবে। কৃষিকাজের সময় বজ্রপাতের পূর্বাভাস সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।

৭. গবেষণা ও উন্নয়ন

বাংলাদেশে বজ্রপাতের ধরন ও প্রভাব নিয়ে আরও বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রয়োজন। স্থানীয়ভাবে উপযোগী প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে।

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ

বাংলাদেশ সরকার বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। কিছু বেসরকারি সংস্থাও বজ্রপাত সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

বজ্রপাত মোকাবিলায় বাংলাদেশ জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন সংস্থার সাথে কাজ করছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রচেষ্টা বাংলাদেশে বজ্রপাতের প্রভাব কমাতেও ভূমিকা রাখবে।

ভবিষ্যৎ করণীয়

১. প্রতিটি ইউনিয়নে কমপক্ষে একটি করে বজ্রপাত নিরোধক টাওয়ার নির্মাণ

২. প্রতিটি স্কুলে বজ্রপাত নিরাপত্তা ড্রিল চালু করা

৩. কৃষি কাজের সময়সূচি বজ্রপাত ঝুঁকি বিবেচনায় আনা

৪. স্থানীয় পর্যায়ে বজ্রপাত সতর্কীকরণ কমিটি গঠন

৫. বজ্রপাতে নিহতদের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান

উপসংহার

বজ্রপাতের কারণে বাংলাদেশ বড় ধরনের প্রাকৃতিক হুমকির মুখে। তবে সঠিক সচেতনতা ও প্রস্তুতির মাধ্যমে এর ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। ব্যক্তিগত সতর্কতা, প্রযুক্তির ব্যবহার, সরকারি পদক্ষেপ এবং পরিবেশ সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা বজ্রপাতের ঝুঁকি মোকাবিলা করতে পারি। বাংলাদেশের মতো একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশে বজ্রপাত প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি। সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও সাধারণ জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে বজ্রপাতের ভয়াবহতা থেকে দেশকে রক্ষা করতে। প্রতিটি নাগরিকের উচিত বজ্রপাত সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং নিরাপদ আচরণ মেনে চলা। একই সাথে পরিবেশ সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে বজ্রপাতের ঝুঁকি কমাতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top