শিশু জন্মের পূর্বেই সৃষ্টিকর্তা শিশুটির মায়ের বুকে দুধের আধার তৈরি করে পাঠান। যাতে করে শিশুটির জন্মের পরে খাবারের কোনো সমস্যা না হয়। তেমনি বিশ্বের সকল প্রাণীর খাবারের ব্যবস্থা করেই পৃথিবীতে পাঠানো হয়। রিজিক তথা জীবিকা ও জীবনোপকরণ মানুষের জীবনধারণের অপরিহার্য একটি বিষয়। জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে রিজিকের চাহিদা ও প্রয়োজনীয়তা মানুষ তুমুলভাবে অনুভব করে। সংসারজীবনে আর্থিক টানাপড়েন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যেকোনো সংকট পরিস্থিতিতে মানুষের প্রধানত দুশ্চিন্তা থাকে এই রিজিক নিয়ে। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা এই রিজিককে ঘিরে আবর্তিত হয় প্রতিনিয়ত।
রিজিক মানে শুধু খাদ্য সামগ্রী নয়, এটি জীবন-উপকরণের সবকিছু। সব প্রাণীর জীবন-উপকরণের দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা নিজেই গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বান্দার তাকদিরে যা লিখে রেখেছেন এবং যতোটুকু লিখে রেখেছেন, তা সে ততোটুকু পাবেই। আল্লাহ তায়ালা জীবন-উপকরণ দান করেন। মানুষ নিতেও পারে না দিতেও পারে না, মাধ্যম হতে পারে মাত্র। পবিত্র কোরআনে সুরা হুদ এর আয়াত ৬ এ আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, “জমিনে বিচরণকারী যত প্রাণী আছে, সবার রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহর ওপরে।‘’ তিনি যাকে ইচ্ছা, যে পরিমাণ ইচ্ছা রিজিক দান করেন। আল্লাহ বহু ধরনের রিজিক দ্বারা আমাদের লালন-পালন করছেন। রিজিক এর কয়েকটি স্তর রয়েছে- (১) সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে- টাকা, পয়সা, অর্থ এবং সম্পদ, (২) সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে- শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতা, (৩) সর্বোত্তম স্তর হচ্ছে- পুণ্যবান স্ত্রী এবং পরিশুদ্ধ নেক সন্তান এবং (৪) পরিপূর্ণ স্তর হচ্ছে- মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি।
সমগ্র জীবনে কত টাকা আয় করবো, কে জীবনসঙ্গী হবে সেটা পূর্বেই লিখিত, কবে কোথায় মারা যাবো সেটাও লিখিত এবং কতটা খাবার ও পানীয় গ্রহণ করবো তাও লিখিত বা নির্দিষ্ট। কতগুলো দানা বা ভাত দুনিয়াতে খেয়ে তারপর মারা যাবো সেটা লিখিত। একটি দানাও কম না এবং একটিও বেশি না। কতটাকা আয় করবো সেটা লিখিত কিন্তু, হালাল উপায়ে আয় করবো না হারাম উপায়ে আয় করবো সে সিদ্ধান্ত একান্তই আমার। হালাল উপায়ে সেই একই টাকা আয় করেই আমি মারা যাবো। আর হারাম উপায়ে হলেও ওই টাকাই আয় করবো। এর বেশিও না কমও না।
আমি যে ফলটি আজকে ঢাকায় বসে খাচ্ছি, সেটা হয়ত চীন, ইরান বা সৌদি আরব থেকে ইমপোর্ট করা। ওই গাছে যখন মুকুল ধরেছে তখনই নির্ধারিত হয়েছে যে, সেটি আমার কাছে পৌঁছাবে। এর মধ্যে কত পাখি ওই ফলের উপর বসেছে, কত মানুষ এই ফলটি পাড়তে গেছে, দোকানে অনেকে এই ফলটি নেড়েচেড়ে রেখে গেছে, পছন্দ হয় নি বা কিনেনি। এই সব ঘটনার কারণ একটাই, ফলটি আমার রিযিকে লিখিত। যতক্ষণ না আমি কিনতে যাচ্ছি, ততক্ষণ সেটা ওখানেই থাকবে। এর মধ্যে আমি মারা যেতে পারতাম, অন্য কোথাও চলে যেতে পারতাম, কিন্তু না! রিযিকে যেহেতু লিখিত আমি এই ফলটি না খেয়ে মারা যাবো না। রিযিক বিষয়টি এতোটাই শক্তিশালী! যেই আত্মীয় কিংবা বন্ধু-বান্ধব আমার বাসায় আসছে, সে আসলে আমার খাবার খাচ্ছে না। এটা তারই রিযিক, শুধুমাত্র আল্লাহ্ তা’লা আমার মাধ্যমে তার কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। হতে পারে এর মধ্যে আমাদের জন্য মঙ্গল রয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ! কেউ কারোরটা খাচ্ছে না। যে যার রিযিকের ভাগই খাচ্ছেন। সুরা ত্বালাক ২-৩ আয়াতে আল্লাহ বলেন- “যে আল্লাহকে ভয় করে, আল্লাহ তার জন্য কোনো না কোনো পথ বের করে দেবেন। আর তাকে (এমন উৎস থেকে) রিযিক দেবেন, যা সে ধারণাও করতে পারবে না।”
অনেক সময় এমন হয়, কোনো কারণে অফিসে নির্ধারিত বোনাস আমি পেলাম না, না পেয়ে বললাম, ইস,একটুর জন্য বা এই কাজের জন্য বোনাসটা পেলাম না। আসলে বোনাস আমার তাকদিরেই ছিল না। আল্লাহ তায়ালা আমার ভাগ্যেই রাখেননি। রাখলে আমি অবশ্যই পেতাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, পৃথিবীর সব মানুষ মিলে তোমার ততটুকুই ক্ষতি করতে পারবে যতোটুকু আল্লাহ তায়ালা চান। তেমনিভাবে ততটুকুই উপকার করতে পারবে যতোটুকু আল্লাহ তায়ালা চান। অনেক সময় নিজের বর্তমান দুর্দশা নিয়ে অস্থির ও হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু ধৈর্যের সঙ্গে চিন্তা করে দেখি না যে আমরা সবাই দুনিয়ায় আসার সময় প্রত্যেকেই সবার রিজিক নিয়ে এসেছি। রিজিকের বরাদ্দ আমাদের সবার জন্য আল্লাহর দরবার থেকে নির্ধারিত করা হয়েছে। চাকরি শেষ হয়ে যাচ্ছে বলে ভয় পাই। ভেবে দেখুন আল্লাহ আপনাকে বড় করেছেন, পড়ালেখা শিখিয়েছেন, বিভিন্ন স্থানে চাকরির মাধ্যমে অভিজ্ঞতা দিয়েছেন- নিশ্চয় আল্লাহ আপনার জন্য ভালো কিছু নির্ধারণ করে রেখেছেন। অন্যত্র টেবিল, চেয়ার কক্ষ নির্ধারণ করে রেখেচেন। খুঁজে নিন নিজ চেষ্টায়।
আল্লাহর এক নাম রাজ্জাক অর্থাৎ তিনি রিজিক দাতা। আল্লাহ তায়ালা আমাকে খাওয়াবেন-এই কথা বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। কাজ করতে হবে। রিজিককে কর্মের মাধ্যমে খুঁজে বের করতে হবে। রিজিককে তিনি কর্মপ্রচেষ্টার সাথে সংযুক্ত করে দিয়েছেন এবং প্রত্যেক মাখলুকের রিজিক বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দিয়েছেন। কারও রিজিক আসমানে, সে বিমান চালিয়ে সেখান থেকে তার প্রাপ্য সংগ্রহ করে। কারও রিজিক জমিনে ; সে চাকরি করে, চাষাবাদ করে, ব্যবসা করে তার রিজিক সংগ্রহ করে। কারও রিজিক সমুদ্র তলদেশে, সেখান থেকেই সে তা সংগ্রহ করে। কারও রিজিক মাটির নিচে কিংবা শক্ত পাথরের ভেতরে, মাটি-পাথর ভেঙে তাকে রিজিক বের করতে হয়। কারও রিজিক ময়লা,দূষিত পানিতে, তাকে সেখান থেকেই তা ওঠাতে হয়। কারও রিজিক আগুনে, আগুন নিভিয়ে তাকে নির্ধারিত রিজিক সংগ্রহ করতে হয়। এভাবে আল্লাহ তায়ালা বান্দার রিজিক জমিনের বিভিন্ন প্রান্তরে ছড়িয়ে দিয়েছেন। যার রিজিক যেখানে আছে, সেখান থেকে তুলে আনতে হবে।
দুনিয়া বা ধনসম্পদ উপার্জনের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টাই করতে হবে। তবে, চেষ্টার পরেও কাঙ্ক্ষিত বস্তু অর্জিত না হলে আক্ষেপ না করে মনে করতে হবে, এটা আমার ভাগ্যে ছিল না। মাধ্যম অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। বসে থাকার কোনো সুযোগ নেই। যে ফসল চায়, তাকে ক্ষেতখামার করতে হবে। যে রোগ থেকে আরোগ্য চায়, তাকে ওষুধ খেতে হবে। রিজিক পেতে হলে, সম্পদ পেতে হলে কর্ম-প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এটাই বিধান। এটাই আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ। বান্দার রিজিক বা জীবিকা বৃদ্ধি পায় বিভিন্ন কারণে। সেগুলো হলো- (১) একনিষ্ঠভাবে এক আল্লাহর ইবাদত ও সৎকর্ম করা। -সূরা আন নাহল: ৯৭ (২) সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করা ও ইস্তেগফার পড়া। -সূরা নুহ: ১০-১২ (৩) সর্বাবস্থায় আল্লাহকে ভয় করে চলা। -সূরা আত তালাক: ২ (৪) বেশি বেশি বৈধ রিজিকের জন্যে দোয়া করা। -সূরা বাকারা: ১৮৬ (৫) দৃঢ়তার সঙ্গে আল্লাহর ওপর ভরসা করা। -সূরা আত তালাক: ৩ (৬) অসহায় দরিদ্রদের সাহায্য করা। -সহিহ বোখারি: ২৮৯৬ (৭) হজ ও ওমরাহ করা। -সুনানে তিরমিজি: ৮১০ (৮) আল্লাহর পথে হিজরত করা। (সুরা নিসা-আয়াত-১০০) (৯) আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা। -সহিহ বোখারি: ২০৬৭ (১০) সকাল সকাল ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। -সুনানে আবু দাউদ: ২৬০৬ (১১) ফজরের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা। -সহিহ মুসলিম: ৬৫৭ (১২) মহানবি (সাঃ) বলেন যখন একজন গরিব মিসকিনকে খাবার দান করবে তখন আল্লাহ তায়ালাও তোমার রিজিককে পবিত্র করে দেবেন। এছাড়াও সাধারণ মানুষের প্রতি মমতা দেখানো, দ্বীনি ইলম অর্জনকারীদের জন্য ব্যয় করাও রিজিক বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ঈমানদারদের ভালোবাসাও শ্রেষ্ঠ রিজিক। কারণ আল্লাহ যাকে ভালোবাসেন, তার প্রতি ঈমানদারদের মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেন।
আল্লাহ তাআলা তার একনিষ্ঠ ইবাদতকারীর জন্য তার সব কল্যাণের দরজা খুলে দেন। দুনিয়ার সব অভাব পূরণ করে দেন। আল্লাহ তাআলা বলেন- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা সবর ও নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য গ্রহণ করো। আর আল্লাহ সবরকারীদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ১৫৩)। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন- হে নবি! তাদেরকে বলুন, ‘আমার রব তার বান্দাদের মধ্য থেকে যাকে চান মুক্ত হস্তে রিজিক দান করেন এবং যাকে চান মাপা-জোখা দেন। যা কিছু তোমরা ব্যয় করে দাও তার জায়গায় তিনি তোমাদের আরও দেন, তিনি সব রিজিকদাতার চেয়ে উত্তম রিজিকদাতা।’ (সুরা সাবা : আয়াত ৩৯) আমাদের কাজ শুধু চেষ্টা করে যাওয়া। যে বিষয়ে আল্লাহ হুকুম করেছেন- তা মানা, আর যে বিষয়ে আল্লাহ নিষেধ করেছেন, তা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। রিজিক কমে যাওয়ার কারণগুলো হলো- (১) আল্লাহতায়ালার জিকির থেকে উদাসীনতা মানুষের রিজিকের বরকত উঠিয়ে নেয়। (২) সুদ সম্পদের বরকত নষ্ট করে দেয়। (৩) রিজিক কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ- অকৃতজ্ঞতা। আল্লাহর নিয়ামতের প্রতি শোকরিয়া না করা। আল্লাহ অকৃতজ্ঞদের পছন্দ করেন না। (৪) রিজিকে বরকত আসার জন্য আল্লাহর ওপর ঈমান ও তাকওয়া অবলম্বন অত্যন্ত জরুরি। যে বান্দা এই দু’টি জিনিস অর্জন করতে পারবে না, তার রিজিকে সংকীর্ণতা নেমে আসবে। (৫) গোনাহ ঈমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে এটিও রিজিকের বরকত কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ। কখনও কখনও মুমিন বান্দার দুনিয়ায়ই এর শাস্তি ভোগ করতে হয়, যার ফলে তার ওপর বিপদাপদ, অভাব-অনটন ও অসুস্থতা ইত্যাদি চেপে বসতে পারে।
তাই রিজিকের বরকত সম্পর্কে সবসময় সচেতন থাকতে হবে আমাদেরকে। হালাল পথে রিজিক অন্বেষণ করতে হবে। কেননা হালাল অর্থ উপার্জন করে রিজিক গ্রহণের মধ্যে এক প্রকার শান্তি রয়েছে, যা হারাম উপায়ে উপার্জিত অর্থের মাঝে নেই। রিজিক কষ্টের মাধ্যমেই উপার্জন করে নিতে হবে, আল্লাহ পথ দেখাবেন মাত্র।