আত্মহত্যা একটি মানসিক অসুস্থতা। মানসিক হওয়ায় তা সকলের দৃষ্টিগোচর হয় না। জীবন যুদ্ধের সাহসী লড়াইয়ে দুর্বলতার একটি মুহূর্ত আত্মহত্যা । ছোট বড় নানান ঘটনাতে মানুষ আবেগ প্রবণ হয়ে বাঁচার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে যার ফলাফল এই আত্মহত্যা। জীবনে উত্থান পতন, ঘাত প্রতিঘাত আসবেই। সেই কঠিন সময়ও পার হয়ে যাবে। অন্ধকার মানেই জীবনের সব আশার অপমৃত্যু নয়। ভিডিওটি মানুষের অন্ধকার সময়ে শক্তি এবং নির্দেশিকা প্রদান করবে। আশা করি আজকের ভিডিওটি আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি করবে এবং আত্মহত্যার মতো পাপ কাজ করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে ।
দুই ধরনের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে। এক. আগে থেকে পরিকল্পনা করে, আয়োজন করে, সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেন অনেকে। যেটাকে বলা হয় ডিসিসিভ সুইসাইড। দুই. হুট করে আবেগের রাশ টানতে না পেরে আত্মহত্যা করে ফেলেন অনেকে, যেটাকে বলা হয় ইমপালসিভ সুইসাইড। ডিসিসিভ সুইসাইড যাঁরা করেন, তাঁরা আগে থেকেই কিন্তু আত্মহত্যার ইঙ্গিত দিয়ে থাকেন
কিছু মানুষ আছে পৃথিবীতে অমর হতে চায়। কিছু মানুষ জীবন থেকে পালাতে চায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে প্রতি বছর বিশ্বে আনুমানিক আট লক্ষ মানুষ আত্মহত্যা করে। এই হার লাখে ১৬ জন। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার কোন সীমানা নেই। প্রতিটি দেশেই এটা ঘটে থাকে। বাংলাদেশ উচ্চ আত্মহত্যা প্রবণতার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। আত্মহত্যার মত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে কমাতে হলে সতর্কতা ও সচেতনতা প্রয়োজন। মানুষ মানুষের জন্য। এই স্লোগানকে আত্মস্থ করে যদি আমরা আত্মহত্যা সম্ভাবনাকারী মানুষগুলো চিহ্নিত করে, অন্ধকার সময়ে তাদের শক্তি, সাহস, আস্থা ও বিশ্বাস যোগাতে পারি তাহলে বিশ্বব্যাপী আত্মহত্যা প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।
আত্মহত্যা একটি অস্থায়ী সমস্যার স্থায়ী সমাধান। সমস্যাটি হয়তো একদিন সমাধান করা যেতো কিন্তু তার পথ চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যায়। অস্কার ওয়াইল্ড বলেন “আত্মহত্যা কখনো ব্যাথার অবসান ঘটায় না বরং এটি তা অন্য কারোর উপর চাপিয়ে দেয়।” আত্মহত্যা কোনো উত্তর নয় বরং এটি জীবন যুদ্ধ থেকে পালানোর অজুহাত।
যারা প্রায়ই আত্মহত্যার কথা বলে তাদের একটি বড় অংশ আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার ৯৫ শতাংশ কারণ মানসিক আর ৫ শতাংশ অন্যান্য কারণ। আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায়-
১. ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে মনোমালিন্য বা সমস্যা।
২. দাম্পত্য কলহ, পরকীয়া, প্রেম, যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন।
৩. পরীক্ষায় ব্যর্থতা, ব্যবসায়ের অপুরনীয় ক্ষতি, চাকুরী চ্যুতি।
৪. শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর নিজের প্রতি ঘৃণাবোধ।
৫. শিক্ষাক্ষেত্রে ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি।
৬. উত্যক্ত করা ও আত্মহত্যায় প্ররোচিত করা। প্রতারণার শিকার হওয়া।
৭. দারিদ্র, অপ্রাত্তি, অর্থনৈতিক মন্দা।
৮. আত্মহত্যার উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা।
৯. নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক অস্থিরতা।
১০. নগরায়ন ও পরিবারতন্ত্রের বিলুপ্তি।
১১. দুরারোগ্য ও জটিল রোগ যন্ত্রনা থেকে অব্যাহতি।
১২. চরম হতাশা ও হতাশাজনিত মানসিক রোগ। মানসিক সমস্যার জন্য কারো মনোযোগ না পাওয়া
১৩. মাদকাসক্তি ও অ্যালকোহলে আসক্তি।
১৪. সিজোফ্রেনিয়া, মৃগীরোগ।
১৫. ব্যক্তিত্বের সমস্যা, জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম ও বর্ণ বৈষম্যের শিকার হওয়া।
১৬. শারীরিক অসুস্থতা বা জন্মগত মানসিক সমস্যা
১৭। আইনি ঝামেলা বা ঋণগ্রস্ততা
১৮। নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষের সাথে চলাফেরা করা
১৯। সার্বক্ষণিক নির্জনতা বা একাকীত্ব অনুভব করা
২০। আত্মহত্যা করেছে এমন কাউকে জানা ও তাকে নিয়ে গভীর চিন্তা করা।
উপরোক্ত বিষয়গুলোর ফলেই মানুষ আত্মহত্যার মতো ঘৃণ্য এই কাজটি করে থাকে।
আত্মহননের আগে আত্মহত্যাকারীরা সাধারণত নিম্নোক্তভাবে প্রকাশ করে থাকেন— (১) তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃত্যু আর আত্মহত্যা নিয়ে নিজের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন। (২) আত্মহত্যা বা মৃত্যুবিষয়ক কবিতা–গান লিখতে, শুনতে বা পড়তে থাকেন। (৩) নিজের ক্ষতি করেন। প্রায়ই এঁরা নিজের হাত-পা কাটেন, বেশি বেশি ঘুমের ওষুধ খান। (৪) মনমরা হয়ে থাকা, কাজে উৎসাহ হারানো, নিজেকে দোষী ভাবা—এগুলো বিষন্নতার লক্ষণ; যা থেকে আত্মহত্যা ঘটে। (৫) মাদকাসক্তি বা ইন্টারনেটে মাত্রারিক্ত আসক্তি আত্মহত্যায় সহায়তা করে। (৬) সারা রাত জেগে থাকা আর সারা দিন ঘুমানো। (৭) নিজেকে গুটিয়ে রাখা, সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ না নেওয়া। (৮) পড়ালেখা, খেলাধুলা, শখের বিষয় থেকে নিজে দূরে থাকা ইত্যাদি।
আত্মহত্যা প্রতিরোধের উপায়-
এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি না করা যাতে কাউকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। আত্মহত্যা করতে পারে এমন ব্যক্তিকে যে বিষয়গুলো বেশি সাহায্য করতে পারে তা হলো- (১) পরিবার এবং সমাজের সবার সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা (২) সমস্যা সমাধান ও বিরোধ মোকাবেলা করার উপায়গুলোর সহজলভ্যতা (৩) কোনো ধর্মই আত্মহত্যাকে ভালো বলে না। আত্মহত্যা মহাপাপ। এমন বিশ্বাসের ভিত স্থাপন করা, যা আত্মহত্যাকে নিরুৎসাহিত করে এবং নিজেকে ভালবাসার প্রতি উৎসাহিত করে। (৪) আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত করা, অন্যের প্রতি যত্নশীল হওয়ার শিক্ষা দেয়া- যাতে সে নিজেও অন্য থেকে যত্ন পায়। (৫) ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে কথা বলতে দ্বিধা বোধ না করার পরিবেশ গড়ে তোলা। (৬) মাদকাসক্তি ও অসৎ সঙ্গ এর ব্যাপারে সচেতন করা। মাদক পরিহারে উৎসাহিত করতে হবে। কিছুতেই যেন ড্রাগ ব্যবহারের সুযোগ না পায় সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজনে তার প্রিয়জনদের সাহায্য নেয়া যেতে পারে। (৭) স্বাস্থ্যকর খাবার, পরিমিত ঘুম দিনে ৬-৭ ঘন্টা ঘুম ও নিয়মিত ব্যায়ামে উদ্বুদ্ধ করা (৮) গান শোনা, বই পড়া, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা ও ভ্রমণে উৎসাহিত করা। (৯) নৈতিকতার অনুশীলন ও দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রথা গড়ে তোলা (১০) মানসিক কষ্ট লাঘবে কাউন্সেলিং করতে হবে। তার লজ্জা, অপরাধবোধগুলোকে ইতিবাচক দিক দিয়ে তার কাছে তুলে ধরতে হবে। দোষ-ত্রুটি ধরে নয়; সমর্থন দিয়ে সহজ ভাষায় তাকে বোঝাতে হবে। (১১) ব্যক্তির মনের কথা শুনতে হবে. সহমর্মিত হতে হবে। তার আবেগ-অনুভূতির ব্যাপারে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। (১২) আত্মহত্যা করার কারণ সম্পর্কে তার কাছ হতে সরাসরি আলোচনা করতে হবে। (১৩) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোন লেখা দেখলে আত্মহত্যা করতে চায় বা আত্মহত্যা করতে পারে মনে হলে অতিসত্বর তার সাথে দেখা করে এ বিষয় সম্পর্কে কথা বলতে হবে। (১৪) আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে কখনোই একা রাখা চলবে না। (১৫) আত্মহত্যার উপকরণ, যেমন ঘুমের ওষুধ, কীটনাশকের সহজলভ্যতা কমাতে হবে। প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঘুমের ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হবে। যেকোনো ধরনের মানসিক সমস্যা বা আত্মহত্যার ইঙ্গিত পেলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রয়োজন হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে যথাযথ চিকিৎসা করাতে হবে ইত্যাদি। (১৬) আত্মহত্যায় কেউ উদ্যত হলে তার মনে হয় তার থেকে উত্তরণের সব পথই বন্ধ। এ অবস্থা থেকে তাকে বের করার জন্য, পরিস্থিতি মোকাবেলা করার উপায়সমূহ তাকে জানাতে হবে।
আত্মহত্যা প্রবণ ব্যক্তি নিজে কি করবেন- ১. এ ধরনের চিন্তা আসলে নিকট জনের সাথে খোলামেলা কথা বলতে হবে। ২. নিজ হতেই মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের নিকট গিয়ে এ সম্পর্কে আলোচনা করতে হবে। ৩. এ ধরনের কাজে চিন্তা এলে নিজেকে থামাতে হবে, জীবনকে সুযোগ দিতে হবে। কারণ খারাপ সময় দীর্ঘস্থায়ী নয় এটা মনে রাখতে হবে। ৪. নেতিবাচক চিন্তা বাদ দিয়ে ইতিবাচক চিন্তায় মনোনিবেশ করতে হবে। ৫. সমস্যা দেখা দিলে ঠান্ডা মাথায় সেগুলোকে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। ৬. মনে রাখবেন, জীবনকে সুযোগ দিন এটা সুনিশ্চিত যে, জীবন আপনাকে কখনোই ঠকাবেনা।
আরো কিছু বিষয়ে পরিবার ও সমাজ ভূমিকা রাখতে পারে। সেগুলোঃ ৭. পারিবারিক, সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করতে হবে। ৮. একে অপরকে যথেষ্ট সময় দিতে হবে। ৯. কাছের মানুষের দুঃখের কথাগুলোকে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে। ১০. বিনোদনের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। ১১. প্রতি সমস্যাকে চ্যালেঞ্জ নিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। ১২. কীটনাশক ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ ও বিক্রয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ১৩. মিডিয়াকে আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারে আরো সতর্কতা অবলম্বন করে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। ১৪. সর্বোপরি আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবাইকে বিশেষ সতর্ক ও সজাগ হতে হবে। ১৫. মনে রাখতে হবে আত্মহত্যাই চুড়ান্ত সমাধান নয়। বরং সব সমস্যার সমাধান করে সুন্দর জীবন যাপনই চুড়ান্ত সমাধান।
সবশেষে বলা যায়- ছোটখাটো বিষয়ে বেশি আবেগপ্রবণ হবেন না, যা জীবনে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে। আমরাই পারি দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব পরিবর্তনের মধ্যমে জীবনের অন্ধকার মুছে দিতে। কষ্টের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আত্মাকে শক্তিশালী ও অনুপ্রাণিত করা যায় ফলে সাফল্য অর্জন সহজ হয়। বিশ্বাস রাখুন একদিন সব ঠিক হবে শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র, যাতে কোন অন্ধকার আমাদের গ্রাস করতে না পারে। নীরবে কষ্ট পাওয়া মানুষগুলো আত্মহত্যার স্বীকার হয়। তাই জীবনকে গ্রহণ করুন, আত্মহত্যা প্রত্যাখ্যান করুন।