হাজার হাজার বছরের ইতিহাস সমৃদ্ধ এ বাংলাদেশ। উর্বর এ ভূমিতে জন্ম নিয়েছে অনেক জ্ঞাণী, গুণী, পন্ডিত। তাদেরই একজন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান পাল সাম্রাজ্যের আমলের একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, বৌদ্ধ ভিক্ষু, বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারক ও সমাজ সংস্কারক ছিলেন। ধর্ম , দর্শন ও সাহিত্য ক্ষেত্রেও অতীশ দীপঙ্কর এর অবদান অসামান্য ও বিস্ময়কর । সেই প্রাচীনকালে বাংলাদেশকে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পরিচিত করিয়েছেন। তিনি বার্মা, নেপাল ও চীনের তিব্বতে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন।
জন্ম- দশম-একাদশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি পন্ডিত ৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে বিক্রমপুর পরগণার বজ্রযোগিণী গ্রামে রাজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। যা বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত। তার বাসস্থান এখনও ‘পণ্ডিত ভিটা’ নামে পরিচিত। অতীশ দীপঙ্কর গৌড়ীয় রাজ পরিবারে রাজা কল্যাণশ্রী ও প্রভাবতীর মধ্যম সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার নাম ছিল আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ, বড় ভাই পদ্মগর্ভ এবং ছোট ভাই শ্রীগর্ভ। তিন ভাইয়ের মধ্যে অতীশ ছিলেন দ্বিতীয়।
শিক্ষা- শৈশব থেকেই অতীশ দীপঙ্কর অত্যন্ত মেধাবী ও জ্ঞানপিপাসু ছিলেন । মায়ের কাছে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন । মাত্র তিন বছর বয়সে সংস্কৃত ভাষায় পড়তে শেখা ও ১০ বছর নাগাদ বৌদ্ধ ও অবৌদ্ধ শাস্ত্রের পার্থক্য বুঝতে পারার বিরল প্রতিভা প্রদর্শন করেন। জ্ঞানার্জনের সাথে সাথে তাঁর জ্ঞানক্ষুধাও বৃদ্ধি পেতে থাকে । জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণের জন্য একদিন অতীশ দীপঙ্কর গৃহত্যাগ করে পথে বের হয়ে পড়লেন । ৯৯২ সালে মাত্র দশ বছর বয়সেই প্রাসাদ জীবনে বিরক্ত হয়ে শুরু করেন নির্জনবাস।
মহাবৈয়াকরণ বৌদ্ধ পণ্ডিত জেত্রির পরামর্শে তিনি নালন্দায় শাস্ত্র শিক্ষা করতে যান। ১২ বছর বয়সে নালন্দায় আচার্য বোধিভদ্র তাকে শ্রমণ রূপে দীক্ষা দেন এবং তখন থেকে তার নাম হয় দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। ১২ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বোধিভদ্রের গুরুদেব অবধূতিপাদের নিকট সর্ব শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। ১৮ থেকে ২১ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি বিক্রমশীলা বিহারের উত্তর দ্বারের দ্বারপণ্ডিত নাঙপাদের নিকট তন্ত্র শিক্ষা করেন। এরপর মগধের ওদন্তপুরী বিহারে মহা সাংঘিক আচার্য শীলরক্ষিতের কাছে উপসম্পদা দীক্ষা গ্রহণ করেন। ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের জন্য তিনি পশ্চিম ভারতের কৃষ্ণগিরি বিহারে গমন করেন এবং সেখানে প্রখ্যাত পণ্ডিত রাহুল গুপ্তের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। বৌদ্ধ শাস্ত্রের আধ্যাত্নিক গুহ্যাবিদ্যায় শিক্ষা গ্রহণ করে ‘গুহ্যজ্ঞানবজ্র’ উপাধিতে ভূষিত হন। একত্রিশ বছর বয়সে তিনি আচার্য ধর্মরক্ষিত কর্তৃক সর্বশ্রেষ্ঠ ভিক্ষুদের শ্রেণিভুক্ত হন। পরে দীপঙ্কর মগধের তৎকালীন শ্রেষ্ঠ আচার্যদের নিকট কিছুকাল শিক্ষালাভ করে শূন্য থেকে জগতের উৎপত্তি এ তত্ত্ব (শূন্যবাদ) প্রচার করেন।
জ্ঞানসাধনার জন্য দীপঙ্কর ১০১১ খ্রিষ্টাব্দে শতাধিক শিষ্যসহ দেশত্যাগ করে চলে যান সুমাত্রায়। সেখানকার মহাজ্ঞানী মহাযোগী চন্দ্রকীর্তির কাছে তিনি অধ্যয়ন করেন দর্শনশাস্ত্র , অভিস্ময়ংলকার এবং বোধিচর্যার বহু গ্রন্থাদি। আচার্য ধর্মপালের কাছে দীর্ঘ ১২ বছর বৌদ্ধ দর্শনশাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ের উপর অধ্যয়ন করে ৪৩ বছর বয়সে ভারতের মগধে ফিরে আসেন। মগধের তখনকার প্রধান প্রধান পন্ডিতদের সঙ্গে তাঁর বিভিন্ন বিষয়ে মতবিনিময় ও বিতর্ক হয়। বিতর্কে তাঁর বাগ্মিতা, যুক্তি ও পান্ডিত্যের কাছে তাঁরা পরাজিত হন। এভাবে ক্রমশ তিনি একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী পন্ডিতের স্বীকৃতি লাভ করেন। মগধের রাজা ও জনগণ তার অসাধারণ পান্ডিত্য দেখে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে ‘ ধর্মপাল ’ উপাধিতে ভূষিত করেন । মগধের রাজা ন্যায়পাল দেব পরে অতীশ দীপঙ্করকে বিক্রমশীলা মহাবিহারের প্রধান আচার্যের পদে নিয়োগ করেন। বিক্রমশিলাসহ ওদন্তপুরী ও সোমপুর বিহারে দীপঙ্কর ১৫ বছর অধ্যাপক ও আচার্যের দায়িত্ব পালন করেন। প্রাচীন ভারতের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ছিলেন। সোমপুর বিহারে অবস্থানকালেই তিনি মধ্যমকরত্নপ্রদীপ গ্রন্থের অনুবাদ করেন। এ সময় মহীপালের পুত্র নয়পালের সঙ্গে কলচুরীরাজ লক্ষমীকর্ণের যে যুদ্ধ হয়, দীপঙ্করের মধ্যস্থতায় তার অবসান ঘটে এবং দুই রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তি স্থাপিত হয়।
তিববতে থো-লিং বিহার ছিল দীপঙ্করের মূল কর্মকেন্দ্র। এ বিহারে তিনি দেবতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। এখান থেকেই তিনি তিববতের সর্বত্র ঘুরে ঘুরে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় তিববতে বৌদ্ধধর্মের ব্যভিচার দূর হয় এবং বিশুদ্ধ বৌদ্ধধর্মাচার প্রতিষ্ঠিত হয়। তিববতে তিনি মহাযানীয় প্রথায় বৌদ্ধধর্মের সংস্কার সাধন করেন এবং বৌদ্ধ ক-দম্ (গে-লুক) সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। তিববতবাসীরা তাঁকে বুদ্ধের পরেই শ্রেষ্ঠ গুরু হিসেবে সম্মান ও পূজা করে এবং মহাপ্রভু (জোবো ছেনপো) হিসেবে মান্য করে।
অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা, অনুবাদ ও সম্পাদনা করেন। তিব্বতের ধর্ম, রাজনীতি, জীবনী, স্তোত্রনামাসহ তাঞ্জুর নামে বিশাল এক শাস্ত্রগ্রন্থ সংকলন করেন। তিব্বতি ভাষায় তিনি বৌদ্ধশাস্ত্র, চিকিৎসাবিদ্যা এবং কারিগরি বিদ্যা সম্পর্কে অনেক গ্রন্থ রচনা করেন বলে তিব্বতিরা তাঁকে ‘অতীশ’ উপাধিতে ভূষিত করে।
অতীশ দীপঙ্কর এর ইচ্ছা ছিল তিব্বতে তিন বছর থাকবেন । কাজ শেষ করে আবার ফিরে আসবেন। কিন্তু তিব্বতের মানুষজনকে এমনভাবে ভালোবেসেছিলেন যে, তিব্বতীয়রা তাঁকে এমন শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছিলো যে , অতীশ দীপঙ্কর আর সেসব ছেড়ে দেশে ফিরতে পারেন নি । সুদীর্ঘ ১৩ বছর তিববতে অবস্থানের পর দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ৭৩ বছর বয়সে তিববতের লাসা নগরের নিকটস্থ লেথান পল্লীতে ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দে দেহত্যাগ করেন। তাঁর সমাধিস্থল লেথান তিববতিদের তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ১৯৭৮ সালে চীনে রক্ষিত তাঁর চিতাভস্ম বাংলাদেশে এনে কমলাপুর বৌদ্ধবিহারে রাখা হয়েছে ।
অতীশ দীপঙ্কর তন্ত্রমন্ত্রের অন্ধকারে আচ্ছন্ন এশিয়াকে আলোকিত করেন বলে তাকে ‘দ্য আই অব এশিয়া’বলা হয়। অতীশ দীপঙ্কর বাংলা ও বাঙালির গর্ব।